বিশ্ববাজারে মূল্য হারিয়েছে চিংড়ি

.
.

বাংলাদেশ থেকে বিশ্ববাজারে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি কয়েক বছর ধরে ভালোই হচ্ছিল। প্রতিবছরই বাড়ছিল রপ্তানির পরিমাণ। কিন্তু গেল অর্থবছরে চিংড়ি রপ্তানিকারকেরা ধাক্কা খেয়েছেন। কমে গেছে রপ্তানির পরিমাণ। এর বড় কারণ হলো বিশ্ববাজারে চিংড়ির রপ্তানিমূল্য বেশ কমে গেছে।
হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) বলছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এক পাউন্ড চিংড়ি রপ্তানি করে রপ্তানিকারকেরা গড়ে ৫ ডলার ৮৫ সেন্ট পেতেন। কিন্তু গেল ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তাঁরা চিংড়ি রপ্তানি করেছেন গড়ে ৪ ডলার শূন্য ৭ সেন্টে। এক বছরে রপ্তানিমূল্য কমেছে ৪৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫০ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ কম। রপ্তানি শুধু লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমেনি, আগের বছরের চেয়েও কমেছে। আগের বছর রপ্তানি হয় ৫৫ কোটি ১ লাখ ডলারের চিংড়ি।
বিএফএফইএ ৯ আগস্ট মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে হিমায়িত চিংড়ি ও মাছ রপ্তানি খাতের সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে এসব তথ্যের উল্লেখ রয়েছে।
রপ্তানিমূল্য কমে যাওয়ার বিষয়ে আলাপ করলে একাধিক রপ্তানিকারক জানান, মূলত চারটি কারণে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি চিংড়ির এ দুরবস্থা। প্রথমত, ইউক্রেন-সংকটে মার্কিন ডলারের বিপরীতে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের দর ৫৫ শতাংশ কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মুদ্রা ইউরোর দর ডলারের বিপরীতে ২২ শতাংশ কমেছে। তৃতীয়ত, ইউরোপের বাজারের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে ও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি অনেক কমেছে। চতুর্থত, অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত দেশগুলোতে সস্তা ভেনামি চিংড়ির বাজার দখল।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএফএফইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়বে-কমবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু গত ২০ বছরে চিংড়ির দাম এতটা নেমে যায়নি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা পরিমাণের দিক দিয়ে রপ্তানি ঠিকই ভালো করেছি। কিন্তু আয়ের দিক থেকে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারিনি।’
ইউক্রেন সংকটের আগে ৩৫ রুবল দিয়ে এক ডলার পাওয়া যেত। এখন খরচ হয় ৬২ রুবল। এর মানে হলো আগে এক লাখ ডলারের চিংড়ি আমদানি করলে রাশিয়ার আমদানিকারকদের খরচ করতে হতো ৩৫ লাখ রুবল। সমপরিমাণ চিংড়ি আমদানি করতে এখন লাগে ৬২ লাখ রুবল।
একইভাবে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের ১১০ টাকায় এক ইউরো পাওয়া যেত। এখন ৮৭ থেকে ৯০ টাকায় ইউরো পাওয়া যায়। ডলারের বিপরীতে ইউরোর দর কমেছে ২২ শতাংশ।
রপ্তানিকারকেরা বলছেন, ডলারের বিপরীতে রুবল ও ইউরোর বড় ধরনের দরপতনের কারণে রাশিয়াসহ ইউরোপের দেশগুলোর আমদানিকারকেরা নিত্যপণ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্যের আমদানি অনেক কমিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে পড়ে গেছে বাংলাদেশি চিংড়িও। সে কারণে গত বছর দেশীয় চিংড়ির রপ্তানি কমেছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে দেওয়া চিংড়ি রপ্তানিকারক সমিতির প্রতিবেদনে গত দুটি অর্থবছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কি মূল্যে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করেছে তার কয়েকটি চালানের কপি সংযুক্তি হিসেবে দেওয়া হয়েছে। সবগুলো চালানই বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে সত্যায়িত।
হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের অ্যাপেক্স ফুডস লিমিটেডের ২০১৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বরের তারিখসংবলিত এক চালানে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি প্রতি কেজি চিংড়ি গড়ে ১২ ডলার ৪০ সেন্টে রপ্তানি করেছে। কিন্তু একই প্রতিষ্ঠান এ বছরের ১৯ মার্চ এক চালানে চিংড়ি রপ্তানি করেছে প্রতি কেজি ৭ ডলার ৯৯ সেন্টে।
খুলনার বাগেরহাট সি ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ২০১৪ সালের ২০ এপ্রিল এক চালানে প্রতি কেজি চিংড়ি ১২ ডলার ৮৭ সেন্টে রপ্তানি করে। কিন্তু একই প্রতিষ্ঠান এ বছরের ১১ জানুয়ারি প্রতি কেজি চিংড়ি রপ্তানি করে ১০ ডলার ৮৬ সেন্টে।
খুলনার মডার্ন সি ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর এক চালানে প্রতি কেজি চিংড়ি ১৯ ডলার ৩৬ সেন্টে রপ্তানি করে। একই প্রতিষ্ঠান এ বছরের ৫ মার্চ প্রতি কেজি চিংড়ি রপ্তানি করেছে ৯ ডলার ২০ সেন্টে।
বিএফএফইএর সহসভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘বিশ্ববাজারে চিংড়ির দাম ৪০ শতাংশের বেশি পড়ে গেছে। আমাদের যাদের কাছে ১০ কোটি টাকার চিংড়ি মজুত আছে, তার দাম এখন ছয় কোটি টাকা। এখন আমরা তারল্য-সংকটে পড়েছি। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে আমরা চলতি মূলধন ঋণের অন্তত ৪০ শতাংশ ব্লক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে সুদ দিয়ে ১০ বছর মেয়াদে ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করার সুবিধা চাই।’