রপ্তানি সক্ষমতা ধরে রাখতে দরকার টাকার অবমূল্যায়ন

ফিনএক্সেল আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা l ছবি: ফিনএক্সেলের সৌজন্যে
ফিনএক্সেল আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা l ছবি: ফিনএক্সেলের সৌজন্যে

রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে এই মুহূর্তে টাকার অবমূল্যায়নের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতিদ্বন্দ্বী সব দেশ ইতিমধ্যে তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে। বাংলাদেশ এটা না করলে রপ্তানি সক্ষমতা ভবিষ্যতে ধরে রাখা কঠিন হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফিনএক্সেল আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এমন মতামতই তুলে ধরেছেন দেশের অর্থনীতিবিদেরা। রাজধানীতে গতকাল রোববার ফিনএক্সেল কার্যালয়ে আয়োজিত এ আলোচনা অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু ছিল, ‘ইউয়ানের অবমূল্যায়ন এবং সোনা ও জ্বালানি তেলের দরপতন: বাংলাদেশের ওপর প্রভাব’। ফিনএক্সেলের চেয়ারম্যান মামুন রশিদের সঞ্চালনায় এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রকৃত বিনিময়মূল্যের দিক দিয়ে টাকা এখন ২০ থেকে ২৫ শতাংশ অতিমূল্যায়িত অবস্থায় আছে। রপ্তানি সক্ষমতা ধরে রাখতে হলে টাকার বিনিময়মূল্য কমানোর কোনো বিকল্প এই মুহূর্তে নেই।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল হক বলেন, ‘গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ভারত, চীন, মালয়েশিয়ার মতো প্রতিটি দেশে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। অথচ চলতি বছরের জুন ও জুলাইয়ে এসব দেশের প্রতিটিতে রপ্তানি কমে গেছে। এর অন্যতম একটি কারণ হলো, ওই সব দেশ মুদ্রার মূল্যমান গড়ে ৫ থেকে ১৮ শতাংশ কমিয়েছে, যেখানে টাকার মূল্যমান একই জায়গায় রয়েছে। আমাদের এখন অবশ্যই টাকার একটা অবমূল্যায়নে যাওয়া উচিত।’ সোনার দাম কমলে তা অনুৎপাদনশীল খাতের বিনিয়োগ বাড়াবে বলে মত দেন শামসুল হক।
সাবেক সচিব ফাওজুল কবির বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সমালোচনা করে বলেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্যকে বাজারভিত্তিক করার এখনই সুবর্ণ সুযোগ ছিল। তা না করে উল্টো বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য যেভাবে বাড়ানো হলো, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ।’ টাকার মূল্যমান না কমালে তা প্রবাসী-আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন ফাওজুল কবির।
টাকার মূল্যমান নির্ধারণে সব ধরনের বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ার পক্ষে মত দেন নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চেয়ারম্যান এম শামসুল হক।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে মুদ্রানীতি এখন একটু বেশি রক্ষণশীল, এটাকে আরেকটু ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। আবার সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের অভাব আছে। এখন যদি আমরা টাকার মূল্যমান কমাই, সেটা প্রকৃত কার্যকর হারে বা রিয়েল ইফেক্টিভ রেটে (আরইআর) রপ্তানি কতটুকু বাড়বে, সেটা হিসাব করে দেখতে হবে। আরইআরের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এখন কাজ করা দরকার।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রমের সমালোচনা করে সালেহউদ্দিন আহদেম বলেন, ‘অর্থনীতির প্রধান বিষয়গুলো নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও বেশি কাজ করা দরকার। করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর), ঋণ, ছাদে সৌরবিদ্যুৎ লাগানো—এগুলো ভালো কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু প্রধান দায়িত্ব আছে। সে দিক দিয়ে বিনিময় মূল্য, মুদ্রানীতি, রাজস্ব ঘাটতির বিষয়গুলো নিয়ে আরও বিস্তৃত (কম্প্রিহেনসিভ) কাজ হওয়া দরকার।’
অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহ ব্যাংকিং খাতের জন্য যেমন খারাপ, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রার অতিরিক্ত রিজার্ভও এ খাতের জন্য খারাপ বলে মনে করেন সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, অতিরিক্ত রিজার্ভ দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিকে একবার বড় সমস্যায় ফেলেছিল, বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। মুদ্রার বিনিময়মূল্য নির্ধারণে নিয়ন্ত্রণ ও সংকোচনের একটি সামঞ্জস্য রাখার ওপর জোর দেন তিনি।
সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিকে গতানুগতিক উল্লেখ করে সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘অর্থনীতি সংস্কারের জন্য জোর বা ধাক্কা দেওয়ার মতো কিছু নেই। বিশেষ করে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতিতে বলার মতো কোনো পরিবর্তন আসেনি।’
কার্যকর অর্থনৈতিক সংস্কার করতে ব্যাংক, আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে সামগ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কার করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন এই অর্থনীতিবিদ।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন এটি ক্যাপিটালের অংশীদার ইফতি ইসলাম, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় বিভাগের পরিচালক সিরাজুল আমিন প্রমুখ।