১০ কিলোমিটার সড়ক করতে ১৪ বছর!

৫ বছরের প্রকল্প ১৫ বছরেও শেষ হয়নি। সময়মতো প্রকল্প শেষ না করায় ব্যয় বেড়েছে ৫৮০ শতাংশ। কক্সবাজারের কলাপাড়ায় ২০০১ সালে জাতীয় সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০০৫ সালের জুন মাসে তা শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু যথা সময়ে এ ইনস্টিটিউটটি নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। জমি অধিগ্রহণে জটিলতার কারণে ব্যয় না বাড়িয়ে আরও তিন বছর সময় বাড়ানো হয়, কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।
২০০৯ সালে আবারও ৮০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো করা হয়। সময় দেওয়া হয় ২০১৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত। এ দফায়ও প্রকল্পটি শেষ করতে পারেনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ গত অর্থবছরে আবারও প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৬ সালের জুন করা হয়।
এভাবে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক প্রকল্প সংশোধন করা হয়। এতে ব্যয় ও সময় দুটিই বাড়ে। এসব প্রকল্পে বাড়তি বরাদ্দ দিতে গিয়ে অন্য প্রকল্পে বরাদ্দ কমাতে হয়। এতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। বছরের পর বছর এ ঘটনা ঘটছে। মূলত ক্রয় প্রক্রিয়ার দুর্বলতার কারণে সময় ও ব্যয় বাড়ে।
এ ধরনের আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, আরেক প্রকল্পে সাড়ে ১০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করতে সময় লেগেছে সাড়ে ১৪ বছর। অথচ প্রকল্প পরিকল্পনায় সময় নির্ধারিত ছিল মাত্র তিন বছর। এ ঘটনা ঘটেছে বিরুলিয়া-আশুলিয়া সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে। রাজধানীর যানজট কমাতে বাইপাস সড়ক নির্মাণের জন্য ২০০০ সালের জুন মাসে ২০ কোটি টাকার প্রকল্পটি শুরু হয়। পণ্যের মূল্য বাড়ার কারণে ২০০৯ সাল থেকে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখে সড়ক বিভাগ। পরে দুই দফায় সময় ও খরচ বাড়িয়ে গত ডিসেম্বর মাসে এ সড়কটি নির্মাণ শেষ করা হয়।
সময় ও ব্যয় বাড়ানোর আরেকটি বড় উদাহরণ সাভারে চামড়াশিল্প নগরী স্থাপন। শুধু কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) স্থাপনের জটিলতার কারণে তিন বছরের প্রকল্প ১৩ বছরেও শেষ হয়নি। ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হয়ে ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল, ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৭৫ কোটি টাকা। সিইপিটি স্থাপনের অর্থ ঋণ না অনুদান—এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বিরোধেই কেটে যায় কয়েক বছর। পরে বিষয়টি সুরাহা হলে সিইটিপি নির্মাণের জন্য ৩৯৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও এই দরে তখন কোনো দরদাতা পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালে সর্বনিম্ন দরদাতাকে ৪৭৭ কোটি টাকায় কাজ দেওয়া হয়। এসব কারণে দ্বিতীয় দফা প্রকল্প সংশোধন করে প্রকল্প ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা করা হয়। এতে প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে ৫১৩ শতাংশ।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩১টি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় মোট ২১২টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৬০টিই ছিল সংশোধিত প্রকল্প। এর মানে, এসব প্রকল্পে সময় ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। প্রতি একনেক সভায় গড়ে দুটি সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
গত অর্থবছরে যেসব প্রকল্প সংশোধন করা হয়েছে, সেসব প্রকল্পের মূল ব্যয় ছিল ১৭ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। সংশোধনের পর খরচ বেড়েছে ৮ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে সংশোধিত প্রকল্পগুলোর গড় মূল মেয়াদকাল ছিল তিন বছর চার মাস। সংশোধনের পর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় বছর দুই মাস। সাধারণত একটি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার বছরে এসেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ব্যয় ও সময় বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠায়।
এম হাফিজউদ্দিন খানের মতে, কিছু প্রকল্পকে নমুনা হিসেবে নিয়ে ব্যয় ও সময় কেন বাড়ল, তা তদন্ত করে দেখা উচিত। দ্রুত প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার জন্য বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো সময় ও ব্যয় কমিয়ে দেখিয়ে থাকে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ বাড়ানো হলে এডিপির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। অনেক সময় গাড়ি ব্যবহারসহ অন্যান্য সুবিধার জন্য প্রকল্প পরিচালকেরা প্রকল্প ধরে রাখেন।’
এবারের এডিপিতে ৩২৪টি প্রকল্প রয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের মধ্যে শেষ হবে।