রবি+এয়ারটেল=রবি

মোবাইল অপারেটর রবি ও এয়ারটেলের একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। দেশের এই দুই প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষ করে একটি কোম্পানি হিসেবে তারা আগামী জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু করতে পারবে বলে আশা করছে। তবে পুরো বিষয়টিই একটি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করতে হবে।
গত আগস্টে একীভূত হতে প্রথম আলোচনা শুরু করে রবি ও এয়ারটেলের মালিকানা প্রতিষ্ঠান আজিয়াটা গ্রুপ বারহাদ ও ভারতী এয়ারটেল। এরপর ৯ সেপ্টেম্বর আলোচনার অগ্রগতির বিষয়ে যৌথ বিবৃতি দেয় রবি ও এয়ারটেল। ওই মাসেই প্রতিষ্ঠান দুটি একীভূত হতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) মাধ্যমে সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করে।
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ তানজিব-উল আলম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, একীভূতকরণ নিয়ে আইনেই এর বৈধতা দেওয়া আছে। তাই এটা নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার গবেষণা করার কিছু নেই। অন্যান্য দেশে একীভূত হওয়ার এমন ঘটনার অনুমতি চার সপ্তাহের মধ্যেই পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে যত দেরি হবে, ততই সব পক্ষের ক্ষতি বাড়বে।
প্রতিষ্ঠান দুটিও সেপ্টেম্বরের পরে একীভূত হওয়ার অগ্রগতি নিয়ে কোনো ধরনের বক্তব্য দেয়নি। এ নিয়ে গতকালও রবি ও এয়ারটেলের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। রবির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মুখপাত্র ইকরাম কবীর জানান, তাঁদের কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য নেই। এয়ারটেলের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান শমিত মাহবুব শাহাবুদ্দীনও বলেন, ‘এই বিষয়ে এখন আমাদের কোনো মন্তব্য নেই।’
রবি ও এয়ারটেলের এই একীভূত হওয়া নিয়ে টেলিযোগাযোগ খাতে এখন চলছে নানা বিশ্লেষণ। রবি-এয়ারটেল তো বটেই, দেশের অন্য মোবাইল অপারেটর, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সরকার—নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিষয়টির চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে। সাধারণ মুঠোফোন ব্যবহারকারীদেরও বিষয়টি সম্পর্কে জানার কৌতূহল একেবারে কম নয়।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন। বিটিআরসির সচিব ও মুখপাত্র সরওয়ার আলম এ বিষয়ে
প্রথম আলোকে বলেন, রবি-এয়ারটেল একীভূত হলে টেলিযোগাযোগ খাতটি আরও প্রতিযোগিতামূলক হবে। একীভূত হওয়ার আবেদনটির সব দিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে যত দ্রুত সম্ভব কমিশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে।
রবি-এয়ারটেলের একীভূত বা মার্জার হলে তা হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঘটনা। এর আগে বাংলাদেশে কয়েকটি
উল্লেখযোগ্য অধিগ্রহণ (অ্যাকুইজিশন) হয়েছে। আরেক কোম্পানির কিনে নেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। তবে আর্থিক ও গ্রাহকসংখ্যার দিক থেকে বড় দুই কোম্পানি একীভূত হওয়ার ঘটনা খুব বেশি নেই।
একীভূত হওয়ার পর রবি ও এয়ারটেল—দুই কোম্পানির গ্রাহকেরাই পরিচিত হবেন ‘রবি’ গ্রাহক হিসেবে। আর তখন রবি হবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর। রবির ‘০১৮’ ও এয়ারটেলের ‘০১৬’ কোডযুক্ত সব নম্বরই আগের মতো থাকবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একীভূত ও অধিগ্রহণের (মার্জার অ্যান্ড অ্যাকুইজিশন) মাধ্যমে বড় বড় কোম্পানির এক হওয়ার এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের দুই মোবাইল অপারেটর টি-মোবাইল ও অরেঞ্জ একীভূত হয়ে এভরিথিং এভরিহোয়্যার (ইই) নামে ব্যবসা করছে। তবে এখন পর্যন্ত অর্থনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অধিগ্রহণের ঘটনা হচ্ছে ১৯৯৯ সালে। জার্মানির মোবাইল অপারেটর মানেসমানকে অধিগ্রহণ করে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান ভোডাফোন, ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে।
রবি ও এয়ারটেলের একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে কী পরিমাণ অর্থের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তা প্রকাশ করা হয়নি। তবে বর্তমানে রবির বার্ষিক আয় ৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর এয়ারটেলের বার্ষিক আয় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। যৌথ কোম্পানি হিসেবে অপারেটর দুটির বার্ষিক আয় দাঁড়াবে কমপক্ষে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৫ কোটি ৫৫ লাখ গ্রাহক নিয়ে মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে শীর্ষে আছে গ্রামীণফোন। ৩ কোটি ২৬ লাখ গ্রাহক নিয়ে বাংলালিংক দ্বিতীয়, ২ কোটি ৮৩ লাখ গ্রাহক নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে রবি। এয়ারটেলের গ্রাহক ১ কোটি, রাষ্ট্রায়ত্ত অপারেটর টেলিটকের গ্রাহকসংখ্যা ৪১ লাখ ৮ হাজার আর সিটিসেলের গ্রাহকসংখ্যা ১১ লাখ ১৩ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মোবাইল ফোন সেবার ক্ষেত্রে গ্রামীণফোনের দখলে আছে ৪২ শতাংশ বাজার। বাংলালিংকের ২৫ শতাংশ, রবির ২২ শতাংশ, এয়ারটেলের ৭ শতাংশ, টেলিটকের ৩ শতাংশ এবং সিটিসেলের ১ শতাংশ।
বিনিয়োগ বিশ্লেষক ও আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় টেলিকম খাতে কোনো কোম্পানির বাজার অংশীদারত্ব নির্ধারিত একটি অংশ নিশ্চিত করা গেলে ওই কোম্পানি না লাভ, না লোকসান অবস্থায় পৌঁছায়। এর ওপরে যার যত বাজার অংশীদারত্ব থাকে, সেই অনুপাতে সে লাভের দেখা পায়। তাই রবি ও এয়ারটেল একীভূত হলে তাদের লাভের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। এ ছাড়া একীভূত হওয়ার ফলে মানবসম্পদের ব্যবহার ভালো হবে। বিভিন্ন ধরনের সম্পদে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও আর্থিক সাশ্রয় ঘটবে।
মোবাইল ও টেলিযোগাযোগ সেবায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তরঙ্গ। একীভূত রবি-এয়ারটেলের মোট তরঙ্গের পরিমাণ দাঁড়াবে সব মোবাইল অপারেটরের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ। বর্তমানে এয়ারটেলের কাছে ২০ মেগাহার্টজ আর রবির কাছে আছে ১৯ দশমিক ৮০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ। দুটি প্রতিষ্ঠানের মোট তরঙ্গের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৯ দশমিক ৮০ মেগাহার্টজ। বর্তমানে গ্রামীণফোনের কাছে সর্বোচ্চ ৩২ মেগাহার্টজ তরঙ্গ আছে। উন্নত মানের ভয়েস কল, দ্রুতগতির ইন্টারনেট থেকে শুরু করে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল সেবা দেওয়ার জন্য তরঙ্গ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
গ্রামীণফোনের প্রধান করপোরেট অ্যাফেয়ার্স কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন রবি ও এয়ারটেলের একীভূত হওয়ার ঘটনাকে স্বাগত জানান। তবে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘একীভূত কোম্পানির কাছে যে তরঙ্গ থাকবে, তার তুলনায় গ্রামীণফোনের গ্রাহকসংখ্যা বিবেচনায় নেওয়া হলে আমাদের তরঙ্গ অনেক কম হবে। ১ হাজার ৮০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের তরঙ্গ নিলামে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে গ্রামীণফোনের ওপর যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, সেটি বহাল থাকবে কি না, সে সম্পর্কে জানতে চেয়ে বিটিআরসিকে একটি চিঠি দিয়েছি আমরা।’
এদিকে, নতুন গঠিত কোম্পানিতে রবির অংশ থাকবে ৭৫ শতাংশ আর এয়ারটেলের থাকবে ২৫ শতাংশ মালিকানা। বর্তমানে রবির ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ শেয়ারের মালিক মালয়েশিয়ার আজিয়াটা গ্রুপ বারহাদ আর ৮ দশমিক ৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক জাপানের এনটিটি ডোকোমো। এয়ারটেল বাংলাদেশের ১০০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ভারতী এয়ারটেল।
বাংলাদেশে এর আগে ২০০৪ সালে সেবা টেলিকমকে কিনে নিয়ে বাংলালিংক নামে ব্যবসা শুরু করে মিসরের ওরাসকম টেলিকম। একইভাবে ২০১০ সালে ওয়ারিদ টেলিকমকে অধিগ্রহণের মাধ্যমেই বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে এয়ারটেল। টেলিযোগাযোগ খাতের বাইরে ব্যাংকিং ও অন্যান্য খাতেও বাংলাদেশে এমন বেশ কিছু অধিগ্রহণের উদাহরণ আছে।
একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়াটির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে রবি ও এয়ারটেলের শীর্ষস্থানীয় কর্তারা বলছেন, চারটি বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখা হচ্ছে। বিষয়গুলো হলো গ্রাহক স্বার্থ, দেশের স্বার্থ, প্রতিষ্ঠান দুটিতে কর্মরত কর্মীদের স্বার্থ ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ।
সারা দেশে রবি ও এয়ারটেলের ১০০-এর বেশি নিজস্ব গ্রাহকসেবা কেন্দ্র, ১১ হাজার পরিবেশক ও আড়াই লাখ খুচরা বিক্রেতা এক ছাতার নিচে চলে আসবে। রবি ও এয়ারটেলের মোবাইল টাওয়ার আছে ১৪ হাজারের বেশি, এর মধ্যে রবির টাওয়ার সংখ্যা ৮ হাজার ৭০০ ও এয়ারটেলের সাড়ে ৫ হাজার।
আজকের রবির বাংলাদেশে যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। টেলিকম মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের শিল্পগোষ্ঠী এ কে খান গ্রুপের যৌথ অংশীদারির এই কোম্পানি ২০১০ পর্যন্ত একটেল নামে পরিচালিত হয়। যাত্রা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত রবি বাংলাদেশে ১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। আর ওয়ারিদ টেলিকমকে ২০১০ সালে কিনে নিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে এয়ারটেল। এখন পর্যন্ত এ দেশে এয়ারটেল বিনিয়োগ করেছে ১২ হাজার কোটি টাকা।
রবি-এয়ারটেল একীভূত হলে প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে কর্মরতদের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়েও নানা আলোচনা হচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি একীভূত হওয়ার এই আবেদনে প্রাথমিক সম্মতি দিলেও সঙ্গে এটিও জানিয়েছে, দুই প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকেই চাকরিচ্যুত করা যাবে না। একই সঙ্গে একীভূত কোম্পানিতে যাঁরা যোগ দিতে চান না, তাঁদের আর্থিক সুবিধার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে বলেছে বিটিআরসি।
বিটিআরসিতে জমা দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী, এয়ারটেলের সব দায়-দেনার দায়িত্ব নেবে রবি। ভারতী এয়ারটেলের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল ২০১৪ থেকে মার্চ ২০১৫ পর্যন্ত এয়ারটেল বাংলাদেশের মোট সম্পদের অর্থমূল্য ৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি দেনার পরিমাণ ৪ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটির কর-পরবর্তী লোকসান হয়েছে ৬৭৪ কোটি টাকা। আর রবি ২০১৪ সালে কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে ৪৪০ কোটি টাকা।
বিদেশি দুটি প্রতিষ্ঠান অপারেটর দুটির সম্পদ মূল্যায়নের কাজ সম্পন্ন করেছে। আগামী ডিসেম্বরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে কোম্পানি দুটির পরিচালনা পর্ষদের সভা হওয়ার কথা আছে। পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে একীভূতকরণের আইনি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা।
কোম্পানি আইন, ১৯৯৪ অনুযায়ী একীভূত হতে আদালতের অনুমোদন নিতে হয়। একীভূতকরণের ফলে যে কোম্পানি সম্পদ পাচ্ছে, সেখানে অনেকগুলো বিষয়ে তৃতীয় পক্ষ জড়িত থাকে। তৃতীয় পক্ষ তিন ধরনের হতে পারে। এরা হচ্ছে যে কোম্পানি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে তার কর্মী, ওই কোম্পানির সরবরাহকারী এবং পাওনাদার। এ-সংক্রান্ত আবেদন পরীক্ষা করার সময় তৃতীয় পক্ষ কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি না, সেটাও আদালত লক্ষ রাখেন বলে সংশ্লিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞরা জানান।