ব্যাংকে পদোন্নতিতে বৈষম্য

সরকারি ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম), মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (ডিএমডি) নিয়োগ-পদোন্নতিতে বৈষম্য চলছে।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন পাঁচ বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) কর্মকর্তাদের তুলনায় তিন পদে নিয়োগ-পদোন্নতিতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংক ও অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। নিয়োগ-পদোন্নতির নিয়মের ভিন্নতার কারণে এ পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। 

তিন পদে নিয়োগ-পদোন্নতিতে রাষ্ট্রমালিকানাধীন পাঁচ বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আইসিবির ক্ষেত্রে নিয়ম এক রকম। আবার সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংক ও অন্য সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নিয়মটা অন্য রকম। জটিলতাটা শুরু হয় ডিজিএম থেকে জিএম পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে, যার রেশ চলে ডিএমডি পর্যন্ত। 

অথচ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়েই সবাই এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন। বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডিজিএম থেকে ডিএমডি পর্যন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ অবিচারের জন্য তাঁরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকেই দায়ী করেন।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোনালী, জনতা ইত্যাদি ব্যাংক যখন কোম্পানি হয়ে যায়, তখনই এদের পর্ষদকে ডিজিএম থেকে জিএম পদে পদোন্নতির ক্ষমতা দেওয়া হয়। অন্যরা সম্পূর্ণ সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় বলে তাদের বিষয়টি পুরোপুরি সরকারই দেখে থাকে।’ 

সোনালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংকে তিন বছর চাকরি পূর্ণ হওয়ার পর প্রতিবছরই শূন্য পদের বিপরীতে ডিজিএম থেকে জিএম পদে পদোন্নতি দিয়ে আসছে এগুলোর পরিচালনা পর্ষদ। রূপালী ব্যাংক, বিডিবিএল এবং আইসিবির পর্ষদকেও গত বছর একই ক্ষমতা দেওয়া হয়। যদিও এগুলোর মধ্যে আইসিবি কোনো কোম্পানি নয়, বরং সরকারি বিনিয়োগ সংস্থা। 

কিন্তু বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব), বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি), আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক এবং সদ্য প্রতিষ্ঠিত পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ক্ষেত্রে ডিজিএম পদে তিন বছর চাকরি পূর্ণ হলেই তাঁদের জিএম পদে পদোন্নতির জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে না। কারণ, তাঁদের ক্ষেত্রে পদোন্নতি দেওয়ার কাজটি করে থাকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।   

জানা গেছে, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ডিজিএম থেকে জিএম পদে পদোন্নতি দিতে সরকার চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগাচ্ছে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে পরীক্ষা নেওয়াসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এরপর জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এবং পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) অনুকূল প্রতিবেদনসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অনুমোদন করলেই পদোন্নতির আদেশ জারি করা হয়। এই প্রক্রিয়াগত দেরির কারণে সোনালী, জনতা ইত্যাদি ব্যাংকের চেয়ে বিকেবি, রাকাব ইত্যাদি ব্যাংকের ডিজিএমেরা দেরিতে জিএম হচ্ছেন।

সমস্যাটা ‘সংকট’ আকার ধারণ করে জিএম থেকে ডিএমডি পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে। ডিএমডি পদের জন্য সবারই জিএম হিসেবে তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। কিন্তু প্রক্রিয়াগত দেরির কারণে জিএম পদে পদোন্নতিই যেহেতু দেরিতে হচ্ছে, তাই ডিএমডি হওয়ার সারিতেও পিছিয়ে থাকছেন বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।

বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর জিএমদের নিয়ে একটি পুল তৈরি করে থাকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। কিন্তু ডিএমডি হওয়ার ক্ষেত্রে পুল থেকে তেমন কেউ আসতে পারেন না। আগে রূপালী ব্যাংক, বিডিবিএল ও আইসিবির কর্মকর্তারাও এই পুলের আওতায় থাকতেন। 

ডিএমডি করার জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তৈরি ১৮ জন জিএমের সর্বশেষ তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, এর মধ্যে ১৬ জনই বাণিজ্যিক ব্যাংকের, দুজনকে পুল থেকে নেওয়া হয় যাঁরা বিশেষায়িত ব্যাংকের। এই দুজনকে পদোন্নতি দিতে দিতেই একজন অবসরে চলে যান, আরেকজন অবসরে যাবেন কয়েক দিনের মধ্যেই।  

বিকেবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে উদাহরণ দিয়ে বৈষম্যের চিত্রটি তুলে ধরেন এভাবে, ২০০৯ সালে ডিজিএম হয়ে তিন বছর চাকরি শেষে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে জিএম হয়েছেন ২০১২ সালে। আর ২০০৭ সালে ডিজিএম হয়ে পাঁচ বছর চাকরির পর ২০১২ সালে তাঁরা কয়েকজনও জিএম হয়েছেন। তিন বছর শেষে ২০১৫ সালে সোনালী ব্যাংকের জিএমেরা ঠিকই ডিএমডি পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। অথচ বিকেবির জিএমদের পদোন্নতির প্রক্রিয়াটি সরকার শুরুই করেছে ২০১৬ সালে।

পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া ডিএমডি ফিরোজ খান গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা না ঘরকা, না ঘাটকা এবং সরকারই তা তৈরি করে রেখেছে। ডিজিএম হওয়ার পরই বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা গাড়িঋণ পান, যা দেওয়া হয় না বিশেষায়িতদের।’    

পদোন্নতি দেওয়ার জন্য বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা যাচাইয়ের জন্য জীবনবৃত্তান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও সরকার বৈষম্য করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সাধারণত ডিসেম্বরভিত্তিক বয়সের হিসাব করে থাকে। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকের একজনকে আনুকূল্য দেখাতে গিয়ে গত মার্চে জুনভিত্তিক বয়সসীমা চেয়েছে এবং ওই ব্যক্তিকে পদোন্নতিও দিয়েছে।

বৈষম্য দূরীকরণে সরকারি উদ্যোগ বিষয়ে জানতে চাইলে গত রোববার অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মো. আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতীতের কোনো এক ভুলের কারণে আমলাতন্ত্রে কিছু ঝামেলা থেকেই যায় এবং আমাদের নজরে এলে সেগুলো দূর করার উদ্যোগ নেই। এ ক্ষেত্রেও তাই করব।’