এইচএসসি, এসএসসি ও পঞ্চমে প্রতিদিন ক্লাস

দেড় বছর পর ১২ সেপ্টেম্বর থেকে খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্রেণির ক্লাসের সংখ্যা বাড়ানো হবে।

করোনার কারণে প্রায় দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর আবার খুলছে। স্কুলের পুরোনো পোশাক ছোট হয়ে গেছে রাজধানীর সদরঘাটের কে এল জুবিলী স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শুভ্র হালদারের। তাই বাবা সুজন হালদারের সঙ্গে মার্কেটে গেছে সে নতুন পোশাক কিনতে। গতকাল দুপুরে রাজধানীর সদরঘাট এলাকায়।
ছবি: দীপু মালাকার

করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে দেড় বছর ধরে বন্ধ থাকার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে নানা আলোচনার মধ্যে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জানাল ১২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীর ক্লাস শুরু হবে। প্রথম দিকে শুধু চলতি বছরের এবং আগামী বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং প্রাথমিকের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ক্লাস হবে। বাকি শ্রেণিগুলোর ক্লাস সপ্তাহে এক দিন করে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে গতকাল রোববার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আন্তমন্ত্রণালয় সভা শেষে সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। অন্যদিকে প্রাক্-প্রাথমিক স্তরের (শিশু শ্রেণি, নার্সারি, কেজি ইত্যাদি) শিক্ষার্থীদের সশরীর ক্লাস আপাতত বন্ধই থাকছে বলে জানিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।

করোনার কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি চলছে। দীর্ঘ বন্ধের ফলে প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত চার কোটির বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারের সবশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছুটি আছে। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে এই ছুটি আর বাড়ছে না।

শুরুতে যেভাবে হবে ক্লাস

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে গতকাল সচিবালয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভা শেষে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সাংবাদিকদের বলেন, প্রথম দিকে ২০২১ ও ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ক্লাস হবে। এর বাইরে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে এক দিন করে ক্লাসে আসবে। একই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দুটি বা কোথাও প্রয়োজনে তিনটি শ্রেণিকক্ষে ভাগ করে বসানো হবে।

কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচি শেষে নবম ও একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরও প্রতিদিন ক্লাস হবে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে প্রতিদিনের ক্লাস ও শ্রেণির সংখ্যা বাড়ানো হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি), জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা এবং বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তুতি থাকবে। পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে পরীক্ষা নেওয়া হবে।

মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম জানান, এইচএসসি, এসএসসি পরীক্ষার্থী এবং পঞ্চম শ্রেণি বাদে অন্যান্য শ্রেণির ক্লাস তাঁরা কোন কোন দিন নেবেন, তার সময়সূচিও আজ সোমবার ঠিক করবেন।

মাস্ক ছাড়া কেউ ঢুকতে পারবে না

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণিকক্ষে ক্লাসের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী। ছোটখাটো যেসব প্রস্তুতি বাকি আছে, তা ৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করা হবে। এই সময়ের মধ্যে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান শুরুর জন্য প্রস্তুতি আছে কি না, তা দেখবেন। খোলার পর শিক্ষকেরা স্কুলে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধিসংক্রান্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত করবেন। প্রতিদিন ঢোকার সময় শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা মাপা থেকে শুরু কোনো উপসর্গ আছে কি না, তা যাচাই করবেন। মাস্ক পরা ছাড়া কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকবে না। মাস্কের ক্ষেত্রে কম বয়সী শিশুদের বিষয়ে শিক্ষকেরা খেয়াল রাখবেন, যাতে তাদের কোনো অসুবিধা হয় কি না।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পর্যায়ক্রমে সারা দেশে দৈবচয়নের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের নমুনা সংগ্রহ করা হবে। কোথাও যদি মনে হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকার কারণে সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি স্থানীয় পর্যায়ে নির্দিষ্ট কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের প্রয়োজন হলে অবস্থা বিবেচনা করে সেটাও করা হবে।

বিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানীর হাজারীবাগ বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ মোহাম্মদ ছায়িদ উল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে তাঁরা প্রস্তুতি নিয়েছেন। সর্বশেষ শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা মাপার জন্য ইনফ্রারেড থার্মোমিটারও কিনেছেন। আজ সোমবার বিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সভা করে বাকি প্রস্তুতি সম্পন্ন করবেন।

মনজুর আহমদ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক আছে। তা যেন ধাপে ধাপে হয়। খোলার পর স্বাস্থ্যগত ও শিক্ষা বিষয়ে অসুবিধা হচ্ছে কি না, সেটা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
মনজুর আহমদ, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

স্কুল-কলেজশিক্ষার্থীদের টিকা

বর্তমানে দেশে ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের করোনার টিকা দেওয়া হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, ১২ বছরের বেশি এবং ১৮ বছরের কম বয়সীদেরও টিকার আওতায় আনা হবে। গতকালও শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, কারিগরি বিষয় দেখে পর্যায়ক্রমে ১২ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষার্থীদেরও টিকা দেওয়া হবে। আবার শিশুদের টিকা দেওয়ার জন্য কিছু বিশেষ ব্যবস্থার দরকার হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসবের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

অবশ্য এ বিষয়ে করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুদের টিকা দেওয়ার পরিস্থিতি এখনো হয়নি। বিশ্বের যে গুটি কয়েক দেশে শিশুদের টিকা দেওয়া হচ্ছে, তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের দেখতে হবে। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ বা বয়স্ক ব্যক্তিদের কমপক্ষে ৫০ শতাংশের টিকা দেওয়ার পর শিশুদের টিকা দেওয়ার বিষয়টি ভাবতে হবে।’

আবারও বৈঠক করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত

পূর্বপরিকল্পনা ছিল ১৫ অক্টোবরের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হবে। কিন্তু এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী গতকাল বলেছেন, আবাসিক শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। অনাবাসিক শিক্ষার্থীদেরও টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। যাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নেই, তাঁদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। এই সপ্তাহে আবারও উপাচার্যদের সঙ্গে বৈঠক হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় অক্টোবরের আগেই প্রস্তুতি থাকলে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক আছে। তবে তা যেন ধাপে ধাপে হয়। আর খোলার পর স্বাস্থ্যগত ও শিক্ষা বিষয়ে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না, সেটা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পরীক্ষা নিয়ে মাতামাতি করা যাবে না। দুই বছরের পরিকল্পনা নিয়ে সব শিক্ষার্থীকে শিক্ষায় ফিরিয়ে আনতে হবে এবং তাদের মৌলিক দক্ষতাগুলো অর্জনের ব্যবস্থা করতে হবে।