ছেলেকে পড়াতে পড়াতে মা-ও পড়লেন

মা মলি রানী ও ছেলে মৃন্ময় কুমার একসঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন
মা মলি রানী ও ছেলে মৃন্ময় কুমার একসঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন

‘নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর নতুন সংসার গোছাতে গিয়ে পড়ালেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। এরই মধ্যে একে একে কোলে আসে দুটি সন্তান। ওরা পড়ালেখা শুরু করে। স্বামীর সামান্য উপার্জন দিয়ে ওদের জন্য গৃহশিক্ষক রাখা সম্ভব হয় না। তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি ওদের পড়াতে বসি। এ সময় অনুভব করি, ছেলেদের পড়াতে হলে নিজেকে আরও পড়ালেখা করতে হবে। তা ছাড়া ছেলেদের পাশে বসে থেকে শুধু শুধু সময় পার করার চেয়ে নিজের জন্য খানিকটা পড়ালেখা করলে ক্ষতি কী? উচ্চশিক্ষিত হতে পারলে পরিবার ও সমাজে আমার সম্মান বাড়বে। এই ভাবনা থেকে আমি বড় ছেলের সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম।’ বলছিলেন নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার গালিমপুর গ্রামের মলি রানী। তিনি স্থানীয় মিষ্টি ব্যবসায়ী দেবব্রত কুমারের স্ত্রী। মলি-দেবব্রত দম্পতির দুই ছেলে, মৃন্ময় কুমার ও পাপন কুমার।
‘একসঙ্গে মা-ছেলের এসএসসি পরীক্ষা’ শিরোনামে প্রথম আলোতে খবরটা প্রকাশিত হয়েছিল গত ৬ ফেব্রুয়ারি। ৫ মে আরও একবার পত্রিকার ‘খবর’ হয়েছেন মা-ছেলে। এবারের শিরোনাম—ছেলের চেয়ে ভালো করেছেন মা। হ্যাঁ, ৪ মে প্রকাশিত এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে জানা গেল, মা পেয়েছেন জিপিএ ৪.৫৩ আর ছেলে মৃন্ময় পেয়েছে ৪.৪৩। বাগাতিপাড়া মডেল পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে কারিগরি শাখায় বিল্ডিং মেইনটেন্যান্স ট্রেডে পড়েছে মৃন্ময়। আর মলি রানী পড়েছেন বাগাতিপাড়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের কারিগরি শাখার ড্রেস মেকিং অ্যান্ড টেইলারিং ট্রেডে।

মা মলি রানী ও ছেলে মৃন্ময় কুমার একসঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন
মা মলি রানী ও ছেলে মৃন্ময় কুমার একসঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন

ফল প্রকাশের পরদিন থেকে মৃন্ময়দের বাড়িতে ভিড় লেগেই আছে। সংবাদকর্মীরা তো বটেই, তাঁকে অভিনন্দন জানাতে এসেছিলেন নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের সাংসদ মো. আবুল কালাম, জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন, একুশে পদকপ্রাপ্ত পলান সরকারসহ অনেকে। ফোনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক। শিগগিরই নাটোরে এসে মা ও ছেলেকে দুটি ল্যাপটপ উপহার দেবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
ভিড়ভাট্টা একটু কমলে গত বুধবার সকালে হাজির হলাম মলি রানীর বাড়িতে। কেমন লাগছে? জানতে চাইলে মলি রানী বলেন, ‘কী বলব বুঝতে পারছি না। এত নামীদামি মানুষ আমাকে শুভেচ্ছা জানাতে বাড়িতে আসবেন চিন্তাও করিনি। এখন আমি আরও পড়ালেখা করার স্বপ্ন দেখছি। ছেলেদের সঙ্গেই পড়ব। ইচ্ছে আছে ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার।’
শুরু থেকেই পরিবারের সদস্যদের সমর্থন পেয়েছিলেন মলি রানী। স্বামী দেবব্রত কুমার, শাশুড়ি তুলসী রানী আর দুই সন্তান সব সময় তাঁর পাশে ছিলেন। বিশেষ করে তাঁর স্বামীর সহায়তার কথা না বললেই নয়। মলি বলছিলেন, ‘আমি যখন রাতে পড়তে বসতাম তখন তিনি আমাকে না ডেকে নিজেই রাতের খাবার খেয়ে নিতেন। পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটাতেন না। আমার লেখাপড়ার জন্য তাঁকে আমি কখনো রাগ করতে দেখিনি।’

পেছনে বাঁ থেকে মৃন্ময় কুমার, দেবব্রত কুমার ও পাপন কুমার। সামনে বাঁ থেকে তুলসী রানী, কল্পনা রানী ও মলি রানী
পেছনে বাঁ থেকে মৃন্ময় কুমার, দেবব্রত কুমার ও পাপন কুমার। সামনে বাঁ থেকে তুলসী রানী, কল্পনা রানী ও মলি রানী

কিন্তু তবু, সংসারের কাজ, স্বামীর ব্যবসায় সহযোগিতা করার পর লেখাপড়ার জন্য সময় বের করতেন কীভাবে? মলি জানালেন, তিনি মনে মনে একটা রুটিন তৈরি করে নিয়েছিলেন। সেটা কেমন? ‘রাত ১০টায় ছেলে মৃন্ময় পড়ালেখা শেষ করে যখন ঘুমাতে যায়, তখন আমি একা একা পড়তাম। রাত আড়াইটা-তিনটা পর্যন্ত পড়ে ঘুমাতাম। সকাল সাতটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে একসঙ্গে তিন চুলায় নাশতা ও দুপুরের খাবার তৈরি করে ফেলতাম। সকাল নয়টা থেকে স্কুল। বেলা একটায় বাড়ি ফেরা। দুপুরের খাওয়া শেষে স্বামীর ব্যবসার কাজে সহযোগিতা করি।’ বোঝা গেল, লেখাপড়া শেখার চ্যালেঞ্জ তিনি ভালোভাবেই গ্রহণ করেছেন।
পরীক্ষার আগে মা-ছেলে প্রস্তুতি নিয়েছেন একসঙ্গে। দুজনে বই-নোট ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। শিক্ষকেরাও আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। ‘মা যে তোমার চেয়ে ভালো ফলাফল করল, মন খারাপ হয়নি?’ প্রশ্ন শুনে মৃন্ময় হাসে। বলে, ‘নাহ। বরং এই প্রতিযোগিতা আমার আরও বেশি কাজে লেগেছে। আমি চাই মা আমার সঙ্গে পড়ালেখা চালিয়ে যাক। ভবিষ্যতে আমি মার চেয়ে ভালো ফলাফল করার চেষ্টা করব।’
স্বামী দেবব্রতও যে স্ত্রী–সন্তানের ফলাফলে ভীষণ খুশি, সেটা অনুমান করাই যায়। ফলাফল শোনার পর তাঁর মিষ্টির দোকানে যে–ই এসেছেন, তাঁকেই িবনে পয়সায় মিষ্টি খাইয়েছেন তিনি। দেবব্রত বলেন, ‘আমি সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। মলি নতুন করে পড়তে চায় শুনে অনেকে নিরুত্সাহিত করেছেন। আমি লোকের কথায় পাত্তা দিইনি। ভেবেছি আমি পড়তে পারিনি, ও (মলি রানী) যদি পড়ে শিক্ষিত হয়, তাতে আমারও সম্মান বাড়বে। ভবিষ্যতেও ও যতটা পড়তে চায়, পড়বে। আমি সহযোগিতা করব। ’
মেয়ের খুশির খবর পেয়ে মা কল্পনা রানী জামাইয়ের বাড়িতে এসেছেন। কথা হলো তাঁর সঙ্গেও। কল্পনার বক্তব্য, ‘অভাবের সংসারে মেয়েকে পড়াতে পারিনি, কম বয়সে বিয়ে দিয়েছি। এ জন্য নিজেদের অপরাধী মনে হতো। এখন মেয়ে নিজের চেষ্টায় পড়ছে। এতে আমার কষ্টটাও কমছে। ওর জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছি।’
আলাপের শেষে মলি রানী জানালেন, বাল্যবিবাহর বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরিতেও কাজ করতে চান তিনি। যেন আর কোনো নারীকে মাঝবয়সে এসে ছেলের সঙ্গে পড়ালেখার কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে না হয়।