বাধা পেরোনো বাহাউদ্দিন

সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলম
সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলম

নিউক্লিয়ার প্রকৌশলে পড়ার ইচ্ছে ছিল সৈয়দ বাহাউদ্দিন আলমের। এখন এ বিষয়েই পিএইচডি করছেন যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর এই যাত্রার পেছনে আছে এক দীর্ঘ পরিশ্রমের গল্প।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার আগেই একটা হোঁচট খেয়েছিলেন তিনি। কেমন সেটা? ‘২০১০ সালের ঘটনা। আমি তখন বুয়েটের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। এ সময় বুয়েটের গ্রুপ মেইলে একটা মেইল আসে এমআইটির অধ্যাপক নেরি অক্সম্যানের কাছ থেকে। তিনি বুয়েট থেকে গবেষণা সহকারী (রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট) নিতে চেয়েছিলেন তখন। তো বন্ধুদের চাপাচাপিতে সিভি মেইল করলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে অক্সম্যান রিপ্লাই করলেন, তিনি আমার ব্যাপারে আগ্রহী। কথা বলতে চান। কিন্তু মাত্র একটা কারণে আমার আর রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়া হলো না।’ বলেন বাহাউদ্দিন। এই কারণটা হলো, তাঁর তখন স্নাতকোত্তর ছিল না। এমআইটিতে সেবার আর যাওয়া হলো না।
কিন্তু এর আগে যে ঘটনাটি ঘটেছিল, সেটাই আসলে বাহাউদ্দিনকে অনেকটা বদলে দেয়। জানালেন, প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাটি তিনি সেই সময় ফেসবুকে শেয়ার করেছিলেন। ঘটনাটি বিশ্বাস করতে পারেনি বন্ধুরা। উল্টো তিরস্কার করেছেন, তাচ্ছিল্য করেছেন। পরে যখন সত্যিই যাওয়া হলো না, তিরস্কারের পরিমাণ বেড়েছিল আরও। এমন ঘটনায় তো হতাশাই পেয়ে বসার কথা। কিন্তু বাহাউদ্দিন কী করলেন? তিনি বলছেন, ‘নেরি অক্সম্যান যখন আমাকে ই-মেইলে জানালেন, স্নাতকোত্তর না থাকায় আমাকে তাঁরা নিতে পারছেন না, আমি তখন একধরনের আত্মবিশ্বাস পেতে শুরু করলাম। আমার যোগ্যতা আছে বলেই তো আমাকে প্রাথমিক সিলেকশনে রাখা হয়েছে। বন্ধুদের কথায় আর কী আসে যায়? এরপর থেকে আমার লক্ষ্য বদলে গেল। টার্গেট ঠিক করলাম—ভিনদেশে পড়তে গেলে প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়েই যাব।’
কিন্তু বুয়েট থেকে বেরোনোর পর হুট করেই ঢুকে পড়লেন একটা চাকরিতে। বাহাউদ্দিনের বাড়ি চট্টগ্রামে, সেখানেই কাজে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করার ভূত তখনো মাথা থেকে নামেনি। চাকরিটা তাই ছেড়ে দিলেন। চট্টগ্রাম থেকে চলে এলেন ঢাকায়। ‘এসে উঠলাম ঢাকা মেডিকেলের হলে এক বন্ধুর কাছে।’ বলেন বাহাউদ্দিন।
কথার মাঝখানে আবার তাঁকে থামাতে হলো। ‘ঢাকা মেডিকেলে কেন?’ বাহাউদ্দিনের উত্তর, ‘চাকরি তো নাই। কী করব, কোথায় থাকব। আর আমার তত দিনে বুয়েটের ছাত্রত্ব শেষ।’ জানালেন, এই সময়টা খুব কষ্টের ছিল। বন্ধুরা কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত। কেবল বাহাউদ্দিন একাই চাকরিবাকরি ছেড়ে লক্ষ্য অর্জনের পেছনে ছুটছিলেন।
অপেক্ষার পালা ঘুচে যায় ২০১২ সালে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি না থাকার কারণে বাহাউদ্দিনকে নেয়নি এমআইটি, শুরুতে একই সমস্যা হলো কেমব্রিজের ক্ষেত্রেও। কিন্তু ই-মেইলের যোগাযোগে বাহাউদ্দিনকে কেমব্রিজের অধ্যাপকের এতটাই পছন্দ হয়েছিল, শর্ত শিথিল করেই পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে জন্য নিতে রাজি হয়েছিলেন তিনি। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি বাহাউদ্দিনকে। কেমব্রিজ থেকেই স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করলেন। পিএইচডি শুরু করলেন।
২০১৬ সালে আমেরিকান নিউক্লিয়ার সোসাইটি এবং ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত নিউক্লিয়ার সম্মেলনে ৫০০ গবেষণাপত্রের মধ্যে তাঁর গবেষণাপত্র ‘বেস্ট পেপার’ অ্যাওয়ার্ড পায়। সেই সঙ্গে সুযোগ মেলে বার্কলে নিউক্লিয়ার বিভাগে স্বল্পমেয়াদি গবেষণার। বর্তমানে তাঁর গবেষণার বিষয় ‘নিম্ন-ক্ষমতাসম্পন্ন (২০% এর কম ইউরেনিয়াম-২৩৫ আইসোটোপ) ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে বাণিজ্যিক জাহাজের জন্য দীর্ঘস্থায়ী পারমাণবিক ব্যাটারি তৈরি’। আর এ গবেষণার জন্য বাহাউদ্দিন আমেরিকার অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন, রোড আইল্যান্ড নিউক্লিয়ার সায়েন্স সেন্টার এবং ব্রাউন ইউনিভার্সিটিতে ‘ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট’ হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। তা ছাড়া এ বছর ‘নিউক্লিয়ার নন-প্রোলিফেরেশন ফেলোশিপ’ পান। যার মাধ্যমে তিনি চীন, জাপান ও কোরিয়ার অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে ঘুরে ঘুরে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছেন। বাহাউদ্দিন চান, বাংলাদেশ থেকে আরও শিক্ষার্থী ভিনদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার সুযোগ পাক।