জোবায়দার জয়যাত্রা

জোবায়দা তাহসিন দেওয়ান। ছবি: খালেদ সরকার
জোবায়দা তাহসিন দেওয়ান। ছবি: খালেদ সরকার

ওয়াং ইয়া মে। চীনা ভাষায় জোবায়দা তাহসিন দেওয়ানের নাম। শুধু নামই নয়, চীন থেকে সুনামও কুড়িয়ে এনেছেন তিনি। কলেজ লেভেলে ‘চায়নিজ ব্রিজ কমপিটিশনে’ (বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের চীনা ভাষায় দক্ষতার পরীক্ষা) বাংলাদেশকে প্রথম স্থানে নিয়ে গেছেন এ লেভেল পাস করা এই তরুণী। ২০১৩ সালেও ‘মিডল স্কুল’ পর্যায়ে একই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সেবার ৬৩টি দেশের মধ্যে ‘বেস্ট স্পিকিং প্রাইজ’ (সেরা বক্তার পুরস্কার) জিতেছিলেন।

শুধু কি তাই? তাঁর অর্জনের ঝুলিতে আছে চীনা সরকারের দেওয়া পূর্ণ বৃত্তি। এইচএসকে (হানইউ শুইপিং কাউশি) পরীক্ষার মোট ৬টি লেভেলের সর্বোচ্চ লেভেল ৫-এ যেখানে ৩০০ নম্বরে ২১০ পেতে হয়, সেখানে লেভেল ৬-এ তিনি পেয়েছেন ২৬৬ নম্বর। এটিও চীনা ভাষায় দক্ষতা যাচাইয়ের পরীক্ষা। মূলত চীনে পড়াশোনা করার জন্য বিদেশি ছাত্রছাত্রীরা আবেদন করলে, তাঁদের চীনা ভাষায় কতটা দখল আছে, তা বিবেচনা করা হয়। জোবায়দার এই ভাষায় বেশ দক্ষতা ছিল বলে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করে নেওয়ার পথটা তাঁর জন্য সহজ হয়ে গিয়েছিল। ১৫ সেপ্টেম্বর আলাপ হলো তাঁর সঙ্গে। সেদিন রাতেই চীনের প্রথম সারির সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফুতান ইউনিভার্সিটির মেডিকেল বিভাগে পড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন তিনি।

জোবায়দার বাবা ব্যবসার কাজে প্রায় ২৫ বছর ধরে চীনে থাকেন। ছোটবেলা থেকে বাবার ইচ্ছে ছিল মেয়ে চীনে গিয়ে পড়ালেখা করবে। এরপর মায়ের অসুস্থতার কারণে ১০ বছর বয়সে প্রথম চীনে পা রাখেন জোবায়দা, সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই রপ্ত করতে শুরু করেন চীনা ভাষা। শুরুর দিকের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন তিনি, ‘প্রথম একটি চায়নিজ মেয়ে আমাকে ওর বই দেখিয়ে একটি শব্দ বলা শেখায়। কিন্তু কিছুতেই ওই ছোট্ট শব্দটা আমি উচ্চারণ করতে পারছিলাম না। প্রায় এক ঘণ্টা লেগেছিল সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে।’ সেই থেকেই জেদ চেপে গিয়েছিল, ভাষাটি তাঁর আয়ত্তে আনতেই হবে।

ভাষা শিখতে গিয়ে আরও অনেক কিছু শেখা হয়ে গেছে জোবায়দার। বলছিলেন, ‘মানুষের কথা বলার ভঙ্গি দেখেও কিন্তু ভাষা সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যায়। একটা নতুন ভাষা শেখার সময় চোখ, কান অনেক তীক্ষ্ণ হতে হয়।’ চীনে কেনাকাটা করার সময় মা-বাবা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। দোকানে গিয়ে জোবায়দা লক্ষ করলেন, কোনো কিছু চাওয়ার আগে সবাই বলছে, ‘ওয়া ইয়াও’। তখন মাথায় এল, সবকিছুর নাম নিশ্চয়ই ‘ওয়া ইয়াও’ নয়। জোবায়দা অনুমান করে নিলেন, এর অর্থ হয়তো ‘আমার চাই’ বা এ রকম একটা কিছু। এভাবেই ধীরে ধীরে এগোতে থাকে ভাষা শিক্ষা। প্রচুর চীনা গানও শুনতেন তিনি।

এরপর বাংলাদেশে ফিরে ভর্তি হলেন কনফুশিয়াস ক্লাসরুমে (সিআরআইএমএফ)। সেখানে এবার পুরোদমে চীনা ভাষা শেখা শুরু হলো। এ লেভেল পড়ার সময় প্রায় দেড় বছর কাজ করেছেন বাংলাদেশে অবস্থিত লিজ ফ্যাশন নামে একটি চীনা ফ্যাশননির্ভর প্রতিষ্ঠানে। সেখানকার স্বত্বাধিকারী ছিলেন লিও নামের এক চীনা নাগরিক। তাঁর সঙ্গে জোবায়দা অনুবাদক হিসেবে কাজ করতেন সপ্তাহে চার দিন। পড়াশোনার পাশাপাশি সমানতালে করে গেছেন এই খণ্ডকালীন চাকরিটি।

অবসরে ভালোবাসেন বই পড়তে। তাও আবার চীনা ভাষায়। জোবায়দা দাবি করলেন, তাঁর মতো চীনা ভাষার এত বই খোদ চীনের অনেক মানুষও পড়েননি। শুধু গল্পের বই-ই নয়, পড়ার বইও পড়েন সমান তালে। ও লেভেলে পাঁচটি স্টার পেয়ে পাস করেছেন এবং এ লেভেলেও বেশ ভালো ফল আছে তাঁর। হাসতে হাসতে জানালেন, ‘মা মাঝেমধ্যে বলে, বই ছেড়ে একটু বাইরে যাও।’

পেশায় চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নটা ছিল ছোটবেলা থেকেই। আর মা-বাবারও এই বিষয়ে ছিল পূর্ণ সহযোগিতা। এখন তাঁর স্বপ্ন সার্থক হতে যাচ্ছে। চীনা দূতাবাস আয়োজিত বেশ কিছু প্রতিযোগিতা, যেমন চায়নিজ নলেজ অ্যান্ড কালচার কমপিটিশন, চায়নিজ পোয়েট্রি কমপিটিশনে (আবৃত্তি) প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন জোবায়দা। শুধু গত বছরই ‘চায়নিজ নলেজ অ্যান্ড পোয়েট্রি রিসাইটেশন কমপিটিশনে’ নিজের ছোট বোনের কাছে হেরে গিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন তিনি। এগিয়ে চলার এই যাত্রায় সহযোগিতার জন্য তাঁর শিক্ষক ও চীনা দূতাবাস কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি কৃতজ্ঞ। জীবনের এতটুকু পথ আসতে যতটুকু যা সাফল্য পেয়েছেন, সব কৃতিত্ব তিনি দিতে চান মাকে।