নিজেরে করো জয়

>এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মৌসুম। কোথায় পড়ব, কীভাবে পড়ব, কেমন কাটবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন—এমন অনেক শঙ্কা যাঁদের মনে, অনুপ্রাণিত হতে পারেন এই তিন তরুণের গল্প থেকে
মো. হাফিজুর রহমান
মো. হাফিজুর রহমান


মুখে কলম ধরে লিখি

মো. হাফিজুর রহমান
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

হাতেখড়ি হয়েছে বাবার কাছে। জন্ম থেকেই আমার দুই হাত-পা এতটাই বিকল যে কলম ধরে লেখার কিংবা হাঁটার মতো শক্তি ছিল না। দুই পা দিয়ে কলম ধরে লিখতাম। গ্রামে প্রাইমারি স্কুল থাকলেও সেখানে কখনো যাওয়া হয়নি। ২০০১ সালে গ্রামে ব্র্যাকের স্কুল চালু হলে নিজ উদ্যোগে ভর্তি হই। সহপাঠীরা সেখানে আমাকে ‘বিয়ারিং গাড়িতে’ করে নিয়ে যেত।

বগুড়ার ধুনটে, বেলকুচি গ্রামে বড় হয়েছি। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। বাবার পেশা কৃষিকাজ হলেও বার্ধক্যজনিত কারণে সেভাবে কাজ করতে পারতেন না। আমার বড় তিন ভাই তত দিনে বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। খুব অভাবে কেটেছে দিনগুলো।

২০০৪ সালের জানুয়ারি মাস। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মাসে ১০০ টাকা অনুদান দেওয়ার আশ্বাস দিলেন। সেই ভরসায় বাবা ধুনট এন ইউ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন। পা দিয়ে লিখতাম। শিক্ষক বললেন, ‘তোমাকে দেখতে সবাই ভিড় জমাবে। ক্লাসে আসার দরকার নেই। পরীক্ষাগুলো শুধু দিয়ো।’ বাড়িতে একা একা পড়ালেখা চালিয়ে গেলাম। এদিকে পা দিয়ে লেখার সময় খাতার ওপর উঠে বসতে হতো। দুই-তিনটি শব্দ লেখার পরই আমাকে পুরো শরীর সরিয়ে নিতে হতো। এই প্রক্রিয়া খুব কষ্টের। সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার পর মুখ দিয়ে কলম ধরে লেখার চেষ্টা শুরু করলাম। এরপর থেকে মুখ দিয়েই লিখি। 

এসএসসি পরীক্ষার সময় আমার বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমের নজরে আসে। আমাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়, প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হয়। তখন ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এসএসসিতে ৪.১৯ পেলাম। ভর্তি হলাম ধুনট ডিগ্রি কলেজে। সেখানে দুই বছরে হাতে গোনা কয়েকটি ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছিলাম। ২০১১ সালে রাজশাহী বোর্ডের অধীনে মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ ৩.৬০ পেলাম।

নিজের প্রচেষ্টায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলাম। জগন্নাথে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে কথা বলে ক্লাস না করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগের জন্য আবেদন জানালাম। স্যারের অনুমতি পেয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম জগন্নাথে।
শিক্ষকেরা আমাকে উপস্থিতির জন্য ন্যূনতম কিছু নম্বর দিয়েছেন, সে জন্য তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সহপাঠী, বন্ধুদের যে ভালোবাসা পেয়েছি, সেটা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। মোটামুটি ভালো ফল নিয়ে স্নাতক শেষ করেছি। এখন স্নাতকোত্তর করছি। হাতখরচ চালানোর জন্য পড়ালেখার পাশাপাশি হুইলচেয়ারে বসেই টি-শার্ট বিক্রি করি।

আক্তারিনা খাতুন
আক্তারিনা খাতুন

ঋণ করে ভর্তি হয়েছিলাম

আক্তারিনা খাতুন

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচিং করতে ঢাকায় আসি, তখন পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ। কোচিং আর ঢাকায় থাকার টাকা জোগাড় করার জন্য বাবাকে অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হয়েছিল। এনজিও থেকেও ঋণ নেন তিনি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম, কিন্তু ভর্তির টাকা পাব কোথায়? এটা আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে অনিশ্চয়তার সময়। এরপর বাবা আবার সুদের কিস্তিতে টাকা ধার করেন। সেই টাকা দিয়ে ভর্তি হই। শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন।

এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি। আমার বাড়ি দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর থানার মাঝাপাড়া গ্রামে। আমার বাবা গ্রামেই ভ্যান চালান। স্কুল-কলেজের পড়াশোনা চিরিরবন্দরে। আমরা দুই ভাইবোন। বাবার আয় খুব সীমিত। সেই আয়েই দুই ভাইবোন পড়াশোনা করছি। আমার বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগ থেকে এ বছর মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছেন।

মাঝেমধ্যে পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তবু থেমে যাইনি আমি। বিভাগের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার পরীক্ষার ফল বেশ ভালো। রেজাল্টের গড় হিসাবে আমি দ্বিতীয় স্থানে আছি। 

শুরুতে থাকার কোনো জায়গা ছিল না। প্রথমে আজিমপুরে পরিচিত এক বড় আপুর সঙ্গে এক সপ্তাহ থাকি। এরপর উঠি এক বান্ধবীর সাবলেট বাসায়। সেখানে থেকেছি এক সপ্তাহের কম সময়। ক্লাস শুরুর পর তিন মাস একরকম যাযাবরের মতো দিন কেটেছে। ভর্তির পর ঢাকায় থাকার জায়গাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিল। প্রথম সেমিস্টারের রেজাল্টও ভালো হয়নি।
এরপর হলে রোকেয়া হলে সিট পাওয়ার পর থাকার সমস্যা দূর হয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন থেকে বৃত্তি ও এইচএসসির ফলাফলের জন্য বোর্ড বৃত্তি পাই। আর্থিক সমস্যা কিছুটা হলেও দূর হয়েছে। ভালোভাবে পড়াশোনা করে বিভাগের ফলাফল ধরে রাখতে চাই। আমার স্বপ্ন—একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হব।

মো. আকাশ হোসেন
মো. আকাশ হোসেন

হারিকেনের আলোয় পড়েছি

মো. আকাশ হোসেন

পুরকৌশল বিভাগ, বুয়েট

জয়পুরহাট জেলার ছোট্ট এক গ্রাম, দোগাছী। সেখানেই আমার বেড়ে ওঠা। গ্রামটির একাংশে গত বছর পর্যন্তও বিদ্যুৎ ছিল না। বুয়েটে চান্স পাওয়ার পর যখন পড়তে এলাম, কাকতালীয়ভাবে এর পরপরই প্রথম আলো জ্বলল আমাদের বাড়িতে। ছোটবেলা থেকে হারিকেন জ্বালিয়ে পড়াশোনা করেছি। বেশি রাত জেগে পড়তে পারিনি। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসতাম।

বাবা রিকশা চালাতেন। মা ছিলেন গৃহিণী। দুজনের কারোরই তেমন অক্ষরজ্ঞান ছিল না, কিন্তু তাঁদের সব সময় স্বপ্ন ছিল আমাদের তিন ভাইবোনকে পড়াশোনা করিয়ে অনেক বড় করবেন। ভাইবোনের মধ্যে আমি বড়, আমার দায়িত্বটাও বড়। প্রাইমারি ও হাইস্কুলে পড়ার সময় বাবার উপার্জন আর স্কুল থেকে প্রাপ্ত উপবৃত্তি সম্বল করে পড়েছি। স্কুলে থাকতে কখনো কোচিং বা প্রাইভেট টিউটরের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কলেজে থাকাকালীন স্যারেরা বিনে পয়সায়ই আমাকে পড়াতেন। 

দোগাছী উচ্চবিদ্যালয় ও জয়পুরহাট সরকারি কলেজ থেকে দুই পাবলিক পরীক্ষাতেই জিপিএ-৫ পাওয়ার পর মা-বাবার স্বপ্নটা আরও উজ্জ্বল হয়। উচ্চমাধ্যমিক শেষে প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছা ছিল। বাবা তাঁর সঞ্চয়ের সব টাকা দিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দেন রাজশাহীতে। যেন সব ভুলে মন দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারি। পরীক্ষা দিলাম বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আল্লাহর রহমতে সবগুলোতে চান্স পেয়েছিলাম। ভর্তি হলাম বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগে।

বয়সের ভারে বাবা এখন আর রিকশা চালাতে পারেন না। টুকটাক দিনমজুরের কাজ করেন। বুয়েটে ‘মানুষ মানুষের জন্য’ নামে একটি দাতব্য সংস্থা থেকে প্রাপ্ত বৃত্তির টাকা আর টিউশনি করে এখন পড়াশোনা করছি। স্বপ্ন একটাই, আমার ছোট দুই ভাইবোনকেও ঠিকমতো লেখাপড়া করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করব। মা-বাবার কষ্ট দূর করে তাঁদের মুখে হাসি ফোটাব।