দেশের বাইরে ইন্টার্নি

ভারতে ইন্টার্নি করতে গিয়েছিলেন এই শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
ভারতে ইন্টার্নি করতে গিয়েছিলেন এই শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত

‘কোথায় ইন্টার্নি করব?’ স্নাতকের শেষ পর্যায়ে অনেক শিক্ষার্থীর মাথাতেই ঘুরপাক খায় এই প্রশ্ন। সিভি হাতে এখানে–ওখানে ধরনা দিয়ে তাঁরা ক্লান্ত হন। কিন্তু বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি ও পশুপালন অনুষদের কিছু শিক্ষার্থীর কথা আলাদা। তাঁরা বরং স্নাতক জীবনের শুরু থেকেই ইন্টার্নির অপেক্ষায় থাকেন। ইন্টার্নি তাঁদের জন্য দুশ্চিন্তা নয়, রোমাঞ্চের আরেক নাম। কারণ অনেকেরই প্রথমবারের মতো বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়ে যায় এই ইন্টার্নির সুযোগে। ভাবছেন ইন্টার্নির সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণের কী সম্পর্ক? ব্যাপারটা খুলেই বলি।

বাকৃবির ছয়টি অনুষদের চারটিতে স্নাতক কোর্স শেষ হয় চার বছরে, অর্থাৎ আট সেমিস্টারে। কিন্তু ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থীদের স্নাতক শেষ হয় ৫ বছরে, পশুপালন অনুষদের শিক্ষার্থীদের লাগে সাড়ে চার বছর। অনুষদ দুটির শেষ সেমিস্টারের ৬ মাসের জন্য ছাত্রছাত্রীদের ইন্টার্নি কর্মসূচিতে অংশ নিতে হয়। দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, খামার, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টার্নি করার সুযোগ পেতে তাঁদের খুব একটা বেগ পেতে হয় না। এমনকি শুধু দেশে নয়, ইন্টার্নি কর্মসূচির একটি নির্দিষ্ট সময় বিদেশের বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, কৃষিভিত্তিক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও অন্যান্য কাজে অংশ নেন অনেক শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত জ্ঞান ইন্টার্নি কর্মসূচিকে কীভাবে কাজে লাগে, কেমন করে বিদেশি গবেষকদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়...এসব নিয়ে মজার সব অভিজ্ঞতা আছে শিক্ষার্থীদের ঝুলিতে।

সম্প্রতি ভারতে ইন্টার্নি কর্মসূচি শেষ করে দেশে ফিরেছেন ভেটেরিনারি অনুষদের ছাত্র সোহেল রানা। হাসিমুখে তিনি বলছিলেন, ‘দেশের বাইরে ইন্টার্নি করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। প্রথমত বিদেশে ইন্টার্নি করার সুবিধা হলো, অর্জিত জ্ঞানগুলোকে সরাসরি কাজে লাগানো যায়, ব্যবহারিক বিষয়গুলো আরও ভালোভাবে শিখে নেওয়া যায়। ভিনদেশের গবেষক, শিক্ষার্থীরা কী ভাবছেন, কী করছেন—এসব সম্পর্কেও আমরা জানতে পারি। তা ছাড়া অনেকের ক্ষেত্রেই প্রথম বিদেশ ভ্রমণ আর প্রথম কাজের অভিজ্ঞতা—দুটো মিলে এক হয়ে যায়। রোমাঞ্চটা তাই অন্য রকম।’

ভেটেরিনারি অনুষদের আরেক ছাত্র নাজমুল হাসান বললেন চেন্নাইয়ের মাদ্রাজ ভেটেরিনারি কলেজে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা। ‘পশুপাখির চিকিত্সা ও চিকিত্সা ব্যবস্থাপনায় তাঁদের কার্যক্রম দেখে অভিভূত হয়েছি। আমাদের দেশে সাধারণত এতটা যত্ন নিয়ে প্রাণিচিকিত্সা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যা শিখেছি, সেগুলো আরও ঝালাই করে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি চেন্নাই গিয়ে।’ শুধু যে কাজের মধ্যে ডুবে ছিলেন, তা নয়। আশপাশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নির সময়টা চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। নাজমুল বলছিলেন, ‘কাজের ফাঁকে ফাঁকে চেন্নাইয়ের মেরিনা বিচ, ক্রিকেট স্টেডিয়াম, পার্ক, পুরাকীর্তি দেখে নিয়েছি। ভারতের নামাক্কল ভেটেরিনারি কলেজে আমাদের টানা কাজ করতে হয়েছে। কঠিন শিডিউলের মধ্যেও অভিজ্ঞতা হয়েছে দারুণ। কলেজের পেছনের খুব সুন্দর একটা পাহাড় ছিল। নামাক্কল ফোর্ট, বিখ্যাত সব মন্দির, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ৬০০ মিটার ওপরে মেঘ-পাহাড়ের মিলনভূমি ছিল দেখার মতো।’

এ বছর নেপাল, জাপান ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টার্নি কর্মসূচিতে অংশ নেন পশুপালন অনুষদের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। নেপালের পাথরিবাস কৃষি অনুসন্ধান কেন্দ্রে ইন্টার্নি কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী সোহরাব হোসেন বলেন, ‘পাহাড়ি অঞ্চলে প্রতিকূল পরিবেশে কীভাবে প্রাণিসম্পদ উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়, বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়া যায় কিংবা কেমন করে প্রাণিসম্পদের জাত উন্নয়নে কাজ করা যায়, এসব বিষয়ে বিশদ ধারণা পেয়েছি আমরা। বেশ কিছু গবেষণা খামার ও প্রতিষ্ঠান ঘুরে ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। সেখানে ছাগল, শূকর ও খরগোশ নিয়ে বেশি গবেষণা হচ্ছে। আমাদের দেশে যেসব গবেষণার সুযোগ রয়েছে, সে বিষয়গুলোতেই আমাদের বেশি আগ্রহ ছিল।’

থাইল্যান্ডের ক্যাসেটসার্ট ইউনিভার্সিটিতে ইন্টার্নি কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া পশুপালন অনুষদের শিক্ষার্থী আবদুল ওয়াহাবকে মুগ্ধ করেছে সেখানকার মানুষের বিনয়। তিনি বললেন, ‘আমরা যখন ইন্টার্নি করছি, তখন দেশটির উত্তর প্রদেশে গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টির একটি স্বেচ্ছাসেবক দলের সঙ্গে ত্রাণ বিতরণ করতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। ওদের ত্রাণ বিতরণ পদ্ধতি এত চমৎকার, না দেখলে বোঝা যাবে না। বিতরণ শেষে ফেরার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল। সেখানকার সেনাবাহিনী আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে দিয়েছিল। তাদের আন্তরিকতাটাই ভালো লেগেছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক জসিমউদ্দিন খান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আগ্রহেই এই ইন্টার্নি কর্মসূচি পরিচালিত হয়। ইন্টার্নি সেমিস্টারের প্রাপ্ত ভাতা ও নিজেদের ব্যয়ে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে যায়। অনুষদগুলো বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে দেয়। বিদেশে আমাদের শিক্ষার্থীরা খুব ভালো করছে বলে আমরা বিভিন্ন দেশ থেকে বেশ ভালো প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি। ইন্টার্নি কর্মসূচি শিক্ষার্থীদের কর্মদক্ষতা বাড়াচ্ছে।’