এখন সাংস্কৃতিক রাজধানী!

ক্যাম্পাসে শীতকালীন আয়োজনগুলোর মধ্যে হিম উৎসব ছিল অন্যতম। ছবি: ইফতেখার রাকিন
ক্যাম্পাসে শীতকালীন আয়োজনগুলোর মধ্যে হিম উৎসব ছিল অন্যতম। ছবি: ইফতেখার রাকিন

শীতের ভোরবেলা কুয়াশায় ঢাকা সমস্ত চরাচর, রাতের কনকনে ঠান্ডায় ভীষণ হাড়কাঁপুনি। তাই বুঝি কবি ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা, আমি তিন মাস ঘুমিয়ে কাটাব।’ কিন্তু না, এই শীতের সময়ই যেন জেগে ওঠে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। আর সেই জাগরণটি উৎসবের। সারা দেশ যখন শৈত্যপ্রবাহের পরাক্রমে থরথর...থরথর, এই ক্যাম্পাসের ছাত্রছাত্রীরা সে সময় থাকেন উৎসবে মাতোয়ারা।

‘শীত এলেই তো আমাদের ক্যাম্পাসে উৎসব শুরু হয়ে যায়। কত রকম উৎসব—প্রজাপতি মেলা, পাখি মেলা, নাট্যপার্বণ ও নাট্য উৎসব, আবৃত্তি উৎসব, হিম উৎসব, সাংস্কৃতিক মেলা...।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সামনে বসে কথা বলছিলেন অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সামিয়া শরীফ।
সামিয়ার কথা শেষে চলুন এবার দ্বিতীয় দৃশ্যে।
দিনকয়েক আগের ঘটনা। ক্যাম্পাসের ট্রান্সপোর্ট চত্বরের পাশের লেকে পরিযায়ী পাখিদের কলকাকলি, কিচিরমিচির। সন্ধ্যায় শীতের হিমেল বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে দুই ছেলেমেয়ের গলা শোনা গেল। একজন বলছেন পাশের জনকে, ‘কী রে, আজ হিম উৎসবে যাবি না?’
‘যাব না মানে! আজ তো উৎসবে ঘাটুগান আছে।’
‘গতকাল যে গেলি না। কাল ছিল উচ্চাঙ্গসংগীত। কী যে গাইল না!’
দুজনের এই কথোপকথনে প্রথমে যিনি কথা বললেন তাঁর নাম অভীক সাহা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন। আর ফারজানা মুক্ত নামে দ্বিতীয় যিনি উত্তর দিলেন, তিনিও নাটক বিভাগের ছাত্রী।
হুম, সামিয়া, অভীক বা মুক্ত—এই শিক্ষার্থীদের কথায় বেশ বোঝা যাচ্ছে, ঢাকার অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে উৎসবের বর্ণিল রঙে রঙিন। যেমন সাংস্কৃতিক সংগঠন জলসিঁড়ির আয়োজনে এখন এখানে চলছে নাটক, লালন-হাসনের গান, ফানুস উৎসব প্রভৃতি নিয়ে সাস্কৃতিক মেলা। সরকার ও রাজনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ওয়াসিম সাজ্জাদ তানভীর বললেন, ‘আট বছর ধরে সাংস্কৃতিক মেলা করছি আমরা।’ আবার ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি হয়ে গেল তিন দিনব্যাপী হিম উৎসব।
শীতের ভেতরে হিম উৎসব বা সাংস্কৃতিক মেলা! ব্যাপারখানা জম্পেশ বটে।
তবে কোনো সংগঠনের ব্যবস্থাপনায় নয়, তিন বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন উদ্যমী শিক্ষার্থীর প্রচেষ্টায় শুরু হয়েছিল হিম উৎসব। তারপর থেকে কবিতা, নাটক, গান—নানা কিছু নিয়ে প্রতিবছরই হচ্ছে এ আয়োজন। ‘এবারের আয়োজনও জমেছিল খুব।’ বললেন অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র সাইমুম সাইদ। তিনি আরও জানালেন, ‘এ বছর উৎসবটি হয়েছিল জহির রায়হান মিলনায়তনের সামনে এবং সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে। শেষ দিন রাতে মুক্তমঞ্চে সহজিয়া ব্যান্ড দারুণভাবে জমিয়ে দিল—শীতেও জমলাম, গানেও জমলাম...হা হা হা।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ। অধিকাংশ উৎসবই হয় ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগে; উদ্যোক্তা প্রধানত শিক্ষার্থীরাই।
গেল নভেম্বর মাসে শীত যখন আসি আসি করছে, প্রজাপতি মেলার মাধ্যমে এখানে তখন শুরু হলো উৎসবের আমেজ। দিনব্যাপী প্রজাপতি মেলার আয়োজন করেছিল প্রাণিবিদ্যা বিভাগের কীটতত্ত্ব শাখা। এ মেলার কিন্তু একটি উদ্দেশ্য আছে, মানুষকে প্রজাপতি চেনানো। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এমফিলের শিক্ষার্থী অনন্যা ঘোষ বললেন, ‘মেলায় প্রজাপ্রতি চেনানোর পাশাপাশি ঘুড়ি ওড়ানোসহ নানান রকম আয়োজন থাকে। আট বছর ধরে অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে মেলাটি করে আসছি আমরা।’
গত শতকের সেই মধ্য সত্তরের দশক থেকে শীতের সময় জাহাঙ্গীরনগরে বিভিন্ন উৎসব হয়ে আসছে, যার শুরু আন্তহল নাট্যোৎসবের মাধ্যমে। এরপর গড়ে উঠল জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার। শুরু থেকে প্রায় প্রতি বছর নাট্যোৎসবের আয়োজন করে তারা। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার (টিএসসি) নাট্যোৎসব করেছিল ৫ থেকে ১০ ডিসেম্বর। আর জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার (অডিটোরিয়াম) ১০ দিনব্যাপী আন্তবিশ্ববিদ্যালয় নাট্যোৎসব করবে আসছে ফেব্রুয়ারির ২ থেকে ১১ তারিখ অব্দি।
আবৃত্তি সংগঠন ধ্বনি এখানে আবৃত্তি উৎসব করেছিল ১৮ থেকে ২৩ ডিসেম্বর।
ক্যাম্পাসের উৎসবগুলোর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য এই, দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের কীর্তিমান ব্যক্তিত্বদের সম্মাননা জানানো হয় প্রতিটি উৎসবে।
এত এত উৎসবের ডামাডোলের মধ্যেই ১১ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে বসেছিল পাখি মেলা। এবারের মেলাটি ছিল ১৭তম আয়োজন। শীতের সময় সুদূর সাইবেরিয়া থেকে সেসব পরিযায়ী পক্ষীকুল জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে আসে, তাদের ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধিই এ মেলার লক্ষ্য।
মুঘোল সুবেদার ইসলাম খাঁ ১৬১০ সালে ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থাপনের পর এর নাম দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর। সেই নাম থেকে এল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। তো, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক, বরেণ্য নাট্যকার সেলিম আল দীন একদা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর অভিধা বোধ করি যথার্থই ছিল, এমন বিচিত্র উৎসবের রং যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তরে, সাংস্কৃতিক রাজধানী তাকে যদি বলা হয়, তাতে নিশ্চয় দোষ ঘটে না!