প্রাঞ্জল প্রাঙ্গণ

পড়ালেখার চাপ থাকলেও ক্যাম্পাসে হাসি–আনন্দে কাটে শিক্ষার্থীদের সময়। ছবি: খালেদ সরকার
পড়ালেখার চাপ থাকলেও ক্যাম্পাসে হাসি–আনন্দে কাটে শিক্ষার্থীদের সময়। ছবি: খালেদ সরকার

দিন কয়েক আগের কথা। ফিলিপ সি জেসাপ ইন্টারন্যাশনাল ল’মুট কোর্ট কমপিটিশনের (আন্তর্জাতিক ছায়া আদালত প্রতিযোগিতা) সমাপনী পর্ব তখন জমে উঠেছে। পারব, নাকি পারব না? এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল ওয়ার্দি জামানের মনে। তাঁর দলের সঙ্গী ছিলেন মুহাম্মাদ নাইমুর রহমান, সুবর্ণা দাশ ও জুবাইদা সাকীন। সেই সময়টার কথা স্মরণ করছিলেন ওয়ার্দি, ‘ভেবে পাচ্ছিলাম না কী করব! আন্তর্জাতিক আইনের ওপর একটি বিবাদ নিয়ে কথা বলার সময় প্রতিপক্ষ আটকে দিয়েছিল আমাকে। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ থেকে হুট করে ক্লাসরুমের কথা মনে পড়ে যায়। ক্লাসে স্যাররা আন্তর্জাতিক আইনের ওপর পড়িয়েছিলেন। হঠাৎ স্যারদের কথাগুলো মনে পড়ে গেল, আমিও ত্বরিতগতিতে বলা শুরু করি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাপিয়ে আমরা বিজয়ী হই।’ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ওয়ার্দি ও তাঁর সহযোদ্ধারা আগামী এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রতিযোগিতার মূলপর্বে বাংলাদেশের পতাকা বহন করবেন। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা নিজেদের দক্ষতা ও মেধার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন।

আরও প্রমাণ পেতে ২০ ফেব্রুয়ারি আমরা হাজির হই ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ধানমন্ডি ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাসে পা রাখতেই পরিচয় হয় দাবাড়ু শওকত বিন ওসমানের সঙ্গে। বিশ্ব দাবা ফেডারেশনের হিসাব অনুযায়ী, তাঁর রেটিং এখন ২০৭৮। গত বছর ঢাকা মহানগর ফিদে রেটিং দাবা প্রতিযোগিতায় শওকত বিন ওসমান অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির আইন বিষয়ের ছাত্র তিনি। বললেন, ‘পড়াশোনার চাপ থাকলেও নিয়মিত দাবাতে সময় দিচ্ছি। আমার শিক্ষকেরাও আমাকে দাবা খেলতে উৎসাহ দেন। যেহেতু আইনে পড়ছি, দাবার চাল চালতে বেশ ভালোই লাগে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে অলিম্পিক ও ওয়ার্ল্ড কাপ খেলতে চাই।’ শওকতের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান ক্লাবের নানান রঙের কাজের খবর জানা গেল। ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাব ও ফোরামসংখ্যা ১৮। সংখ্যাই বলে দেয়, শিক্ষার্থীরা ক্লাব কার্যক্রম নিয়ে কত ব্যস্ত। গণিত অলিম্পিয়াড থেকে শুরু করে ফুটবল প্রতিযোগিতা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব উৎসব-সব মিলিয়ে সারা বছরই ব্যস্ততা থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টি অনুষদের ১১টি বিষয়ে পড়ছেন সাড়ে তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। প্রায় ১৫০ জন শিক্ষক পড়াচ্ছেন তাঁদের। কেমন চলছে পড়াশোনা? শিক্ষার্থী তাহমিনা শান্তা বলছিলেন, ‘স্কুল-কলেজের মতো এখানেও টিচাররা আমাদের হোমওয়ার্ক দিয়ে ব্যস্ত রাখেন। কোনো বাহানায় কাজ হবে না। সময়মতো হোমওয়ার্ক জমা দিতেই হবে।’ এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গেমস রুমের’ দিকে হইচই শুনে সেদিকে পা বাড়াই আমরা। মাতৃভাষা দিবসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পোস্টার আর ব্যানার ডিজাইনের কাজ চলছে। কোলাহলের ভেতরেই কথা হয় এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। ক্লাসরুমে পেছনের দিকে বসেন বলে ‘ব্যাকবেঞ্চার’ বলে পরিচিতি আছে বিবিএর ছাত্র রুহুল আমিনের। ক্লাসরুমে পেছনে বসলে কী হবে, খেলার মাঠে রুহুল আমিন স্ট্রাইকার পজিশনে খেলেন। এই তো গেল বছর চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়ের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের এক আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। সেই দলে ছিলেন রুহুল আমিন। রুহুল আমিন বলেন, ‘প্রতিযোগিতায় আমরা ছিলাম বাংলাদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে মাঠে নামার অনুভূতি বলে প্রকাশ করা যাবে না। শুধু খেলার জন্যই আমরা সেখানে যাইনি, চীনা সংস্কৃতি নিয়ে অনেক কিছু জানার সুযোগ পেয়েছি। আমাদের শিক্ষকেরা ক্লাসরুমে যতটা খেয়াল রাখেন, তেমনি খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সৃজনশীল কাজেও উৎসাহ দেন।’

ধানমন্ডি ক্যাম্পাসে ইষ্টার্ন ইউনিভার্সিটির পাঠাগার
ধানমন্ডি ক্যাম্পাসে ইষ্টার্ন ইউনিভার্সিটির পাঠাগার

বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে গেমস ও স্পোর্টস ক্লাবের সদস্যদের এক আড্ডায় ঢুঁ মেরে গল্প জমানোর চেষ্টা করেছিলাম। ক্লাবের সদস্য শোয়াইব ইসলাম, সাকিব, জান্নাত, তাহমিনা শান্তা আর হিমুর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলো। ক্যারম খেলার ভক্ত, বিবিএ-পড়ুয়া জান্নাত বুশরা বলেন, ‘সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা ক্যাম্পাসেই সময় কাটাই। ক্লাসের পরে গেমস রুমে ক্যারম আর টেবিল টেনিস নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কে কার আগে খেলবে, এ নিয়ে লম্বা লাইন জমে যায়।’ হিমু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ফুটবল আর ক্রিকেটের উন্মাদনার কথা জানান। আশুলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের মাঠে প্রতি সপ্তাহেই চলে ঘামঝরানো প্রশিক্ষণ।

আড্ডা শেষে এবার ক্লাসের কার্যক্রম সম্পর্কে জানার আগ্রহ হলো। শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে আমরা চুপটি করে একটি ক্লাসরুমের পেছনে গিয়ে বসি। ব্যবসায় অনুষদের সেই ক্লাসে কীভাবে আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণা ছাপানো হয়, এ নিয়ে কথা হচ্ছিল। ক্লাস শেষে বিবিএর শিক্ষার্থী রাইসা ঢালী ও জাসির বলেন, ‘আমাদের টিচাররা সব সময়ই গবেষণার বিষয়টা গুরুত্ব দেন। আমরা যেন গবেষণা করতে পারি, সে জন্য এখানে একটা রিসার্চ সেন্টারও আছে।’

বিবিএর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ শেষে পা বাড়াই তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দিকে। বেশ বড় গবেষণাগারগুলোতে দেশি শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিদেশি শিক্ষার্থীও আছেন। চোখে বড় চশমা আর হাতে বৈদ্যুতিক তার নিয়ে ছোটাছুটি করছিলেন একজন। বললেন, ‘সামনে পরীক্ষা।’

দাবাড়ু শওকত বিন ওসমান, পড়ালেখার পাশাপাশি নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়
দাবাড়ু শওকত বিন ওসমান, পড়ালেখার পাশাপাশি নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়

ও হ্যাঁ, পরীক্ষার আতঙ্ক কিংবা সামাজিক-পারিবারিক কোনো চাপ যেন শিক্ষার্থীদের না ভোগায়, সে জন্য ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সাইকোসোশ্যাল কাউন্সেলররা’ শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য কাজ করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানাল, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির সঙ্গে আমেরিকা, ইউরোপ, চীন ও জাপানের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও পাঠ্যক্রমের সংযোগ আছে। বিদেশি শিক্ষক ও গবেষকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দক্ষতা-উন্নয়নে অংশগ্রহণ করছেন। প্রতিবছর শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণার জন্য গবেষণা খাতে ও শিক্ষাবৃত্তির অংশ হিসেবে বেশ বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে তারা।

দিনের শেষে, বিকেলে ক্যাম্পাস থেকে ফিরতে ফিরতে কথা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশলের শিক্ষার্থী আবু হোরাইয়ার সঙ্গে। সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্য হোরাইয়া বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে যে বিভাগেই পড়ুক না কেন, ক্লাবে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে মোটামুটি সবার আগ্রহ আছে।’ হোরাইয়ার সঙ্গে ছিলেন নাহিদ হান্নান ও ফাহিম আহমেদ। আইনে পড়ুয়া এই দুই শিক্ষার্থী যোগ করলেন, ‘বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ্যক্রমটা সাজানো হয় বলেই আমরা পড়ায় আগ্রহ পাই।’

ড. মো. নুরুল ইসলাম
ড. মো. নুরুল ইসলাম

দক্ষতা বিকাশই মূল লক্ষ্য
ড. মো. নুরুল ইসলাম, উপাচার্য, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থানে পরিবর্তন আনতে পারে, সেই চেষ্টা আমাদের আছে। পড়াশোনা শেষে শিক্ষার্থীরা যেন যার যার কর্মক্ষেত্রে দক্ষ নেতৃত্বের গুণাবলি প্রদর্শন করতে পারে, সে জন্য হাতে-কলমে ব্যবহারিক শিক্ষার দিকে আমরা জোর দিই বেশি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দক্ষ প্রকৌশলী, আইনজীবী ও পেশাজীবীরা এখন দেশের নানান ক্ষেত্রে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। আমাদের পাঠ্যক্রম সব সময় আন্তর্জাতিক ও সাম্প্রতিক। ক্লাসরুমের পড়াশোনা ও পরীক্ষা ছাড়াও আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষা ও সৃজনশীল কার্যক্রমকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছি।