স্বপ্ন হলো সত্যি

>মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নবীনদের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকে যাঁরা স্বপ্নের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়েছেন, স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পর তাঁদের কী অনুভূতি? জানিয়েছেন তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তিন শিক্ষার্থী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রোকেয়া হল আমার ঠিকানা
ফাহমিদা ফারজানা, প্রথম বর্ষ, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য

ফাহমিদা ফারজানা
ফাহমিদা ফারজানা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম এসেছিলাম মামার সঙ্গে। বয়স তখন ছয় কি সাড়ে ছয় হবে। প্রথমেই পা রেখেছি চারুকলায়। দেখলাম অনেকে ছবি আঁকছে। কী সুন্দর! আর দেখেছি একটা লাল বাস। আমার স্কুলে তো বাস ছিল না। খুব ইচ্ছে হয়েছিল, বড় হয়ে আমি এই বাসে চড়ব। এখানে পড়ব।

এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল আমার ঠিকানা। হল থেকে এক দৌড়ে কলাভবনে চলে যাওয়া যায়। বাসে চড়ার দরকার হয় না। চারুকলাতেও আমার পড়া হয়নি। আমি পড়ি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে। আমাকে অবশ্য ছোটবেলা থেকে চারুকলাই বেশি টানত। ভর্তি পরীক্ষায় টিকে গিয়েছিলাম। কিন্তু পড়া হয়নি।

ইংরেজি সাহিত্য পড়তেও মন্দ লাগে না। ক্যাম্পাস তো একটাই। আমরা চারুকলা কিংবা টিএসসির ছাদে বসে থাকি। স্বপন মামার দোকানে চা খাই। গভীর রাতে যখন হঠাৎ করে খিদে লেগে যায়, তখন দেখা যায় কারও না কারও ব্যাগ থেকে কোনো না কোনো খাবার বেরিয়ে আসে। কখনো নুডলস, কখনো ডিম। আপুদের সঙ্গে আমরা রাত একটা-দেড়টার দিকে মাঠে বসে গল্প করি। যখন অনেক বাতাস থাকে, কী যে ভালো লাগে!

আমার স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবতা যে পুরোপুরি মিলেছে তা নয়। আমি ভেবেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটা জায়গা যেখানে সবাই স্বাধীন। কিন্তু এখন দেখি, সবাই আসলে সবকিছু সহজভাবে দেখে না। স্কুল-কলেজে যতটা মুক্তমনা ছেলেমেয়েদের পেয়েছি, এখানে তেমন পাই না। বড় হয়ে গেলে সবার দেখার চোখ কেন এমন জটিল হয়ে যায়, জানি না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
বুয়েটের একটা প্রাণ আছে
তৈয়্যব হোসাইন, প্রথম বর্ষ, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগ

তৈয়্যব হোসাইন
তৈয়্যব হোসাইন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) আমার ক্লাস শুরু হয়েছে এক সপ্তাহ হলো। বুয়েটে পড়ার স্বপ্ন দেখেছি সেই ক্লাস টেন থেকে। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল এবং নটর ডেম কলেজে পড়েছি। কলেজে নিয়মিত ক্লাস করতাম, ভালো ফল ধরে রাখার চেষ্টা করতাম। তখন থেকেই একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল, হয়তো বুয়েটে পড়তে পারব। তা ছাড়া বিজ্ঞান আমার সব সময়ের প্রিয় বিষয়। বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাধারাগুলো ভালো লাগে।

স্কুল-কলেজে বিতর্ক করেছি। সেই সুবাদে বেশ কয়েকবার বুয়েট ক্যাম্পাসে আসা হয়েছে। কিন্তু বুয়েট পরিবারের একজন হওয়ার পর বুঝি, বাইরে থেকে আসলে এখানকার ক্যাম্পাসের জীবনটা কখনোই বোঝা যায় না। এই ক্যাম্পাসের একটা প্রাণ আছে। দু-তিন দিন আগের কথা। তখন রাত নয়টা কি সাড়ে নয়টা বাজে। ক্যাফেটেরিয়ার সামনে দিয়ে আসছিলাম, শুনতে পেলাম এক পাশে কারা যেন রবীন্দ্রসংগীত গাইছে, ‘আমার নিশীথরাতের বাদলধারা...’।

শিরোনামহীন আমার প্রিয় ব্যান্ড। শুনেছি শিরোনামহীনের ক্যাফেটেরিয়া গানটা নাকি বুয়েটের ক্যাফেটেরিয়ার কথা ভেবেই লেখা। আগে কখনো আলাদাভাবে গানটা অনুভব করিনি। এখন ক্যাফেটেরিয়ায় বসে চা-টা খেলে হয়তো একটু একটু বুঝতে পারব।

মাত্রই ক্লাস শুরু হয়েছে। পড়ার চাপ খুব একটা টের পাচ্ছি না। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা নানা জেলার ছেলেমেয়েরা এখন আমার সহপাঠী। তাঁদের সঙ্গে আড্ডা দিই, গল্প করি। ভালোই লাগে। বুয়েটে বড় ভাই-ছোট ভাই সম্পর্কটাও খুব ভালো। আমি সোহরাওয়ার্দী হলে থাকি। হলের পরিবেশটা বেশ প্রাণবন্ত। সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে একটা শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সম্পর্ক আছে। ভালো লাগে। তবে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, সেটা বলব না। এখনো তো অনেক দূর যাওয়া বাকি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ
স্বপ্ন নিয়েতেই লিখেছিলাম, চিকিৎসক হব
রুপা দাস, প্রথম বর্ষ

রুপা দাস
রুপা দাস

২০১৪ সালে প্রথম আলোর স্বপ্ন নিয়ে পাতায় আমার একটা লেখা ছাপা হয়েছিল। তখন আমি পটুয়াখালী সরকারি গার্লস স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ি। সেবার লিখেছিলাম, আমার জীবনের লক্ষ্য হলো চিকিৎসক হওয়া। কী আশ্চর্য! আজ আবার যখন লেখার সুযোগ হলো, তখন আমি আমার লক্ষ্য পূরণের পথটা পেয়ে গেছি। তখন স্বপ্নটা অনেক দূরের মনে হতো। অথচ এখন আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ি।

২০১৪ সালের লেখাটায় যে গল্পটা বলেছিলাম, সেটা আরও একবার বলতে ইচ্ছে করছে। আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়তাম, তখন আমাদের স্কুলে একটা নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। আমি নাটকে মহারাজ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত হই। কিন্তু গোঁ ধরেছিলাম, মহারাজের চরিত্র আমি করব না। আমি হব রাজচিকিৎসক! শেষ পর্যন্ত আমার চাওয়াই পূরণ হয়েছিল। সে সময় শিক্ষকেরা আমার অভিনয় দেখে বলেছিলেন, ‘তুমি সত্যিই একজন বড় চিকিৎসক হবে।’ তখন থেকেই মনে মনে চিকিৎসক হওয়ার একটা দৃঢ়সংকল্প করে ফেলেছিলাম। স্বপ্ন নিয়েতে যখন লেখাটা ছাপা হলো, তখন আমার স্বপ্নটার কথা সবাই জেনে গেল। পরিচিত অনেকে দেখা হলে বলত, ‘কী হে ডাক্তার, কী খবর?’ বুঝলাম, আমার প্রতি সবার প্রত্যাশা বেড়ে গেছে।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর জোরেশোরে পড়া শুরু করলাম। আর কোথাও ভর্তি পরীক্ষা দিইনি। আর কোনো কোচিংও করিনি। শুধু মেডিকেলের জন্যই প্রস্তুতি নিয়েছি। এর মধ্যে পরীক্ষার দুদিন আগে আমার জ্বর হলো। আকাশ-পাতাল জ্বর! মনে মনে ভাবছিলাম, স্বপ্নটা বোধ হয় আর পূরণ হবে না। যা হোক, পরীক্ষাটা ভালোমতোই দিলাম।

মনে আছে, ফলাফলের দিন বারবার ‘সার্চ’ করেও আমার রোল নম্বরটা পাচ্ছিলাম না। ভাবলাম, বোধ হয় হয়নি। একটু পর কোচিং থেকে বাবার কাছে ফোন এল। এপাশ থেকে বাবা দেখলাম বেশ নির্বিকার ভঙ্গিতে কথা বললেন, ‘ও আচ্ছা। ধন্যবাদ। ভালো খবর দিলেন।’ ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে। বাবা যখন জানালেন আমি ১৫৬তম হয়েছি, আমি আর মা কেঁদে ফেললাম। বাবার ওপর খুব রাগ হয়েছিল। এত বড় একটা খবরেও তিনি এত নির্বিকার থাকলেন কেন! পরে বাবা বলেছেন, ‘আমি তো জানতাম তুই পারবি।’

এখন সাদা অ্যাপ্রোন পরে ক্লাসে যাই। অদ্ভুত লাগে। সেই ছোটবেলা থেকে এই স্বপ্নটাই তো দেখেছি। যদিও এখন শুধু পড়া আর পড়া। তবু ঢাকা মেডিকেল কলেজের ক্যাম্পাস, বন্ধু, পরিবেশ...সবই ভালো লাগে। স্বপ্নটা এখনো পুরোপুরি পূরণ হয়নি। আমি তো এখনো পড়ছি। পড়া শেষ হলে ভালো চিকিৎসক হব, মানুষের সেবা করব, এটাই লক্ষ্য।