ঋতুর বদলে ক্যাম্পাসের রং বদলায়

>সব ক্যাম্পাসই সুন্দর। প্রতিটি ক্যাম্পাসের আলাদা রূপ আছে। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পাসের চিত্রটাও বদলে যায়। শীতের কুয়াশা কোনো কোনো ক্যাম্পাসকে স্বর্গীয় রূপ দেয়। ঝুমবৃষ্টি কখনো কখনো ভালো করে দেয় শিক্ষার্থীদের মন। মৌসুম বদলের সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পাসের গাছগুলো রং বদলায়। প্রকৃতি, পরিবেশের সঙ্গে প্রিয় প্রাঙ্গণের যে নিবিড় সম্পর্ক, তা নিয়েই আজকের বিশেষ আয়োজন।
শীতে এরা জাহাঙ্গীরনগরের অতিথি। ছবি: হাসিবুর অলি
শীতে এরা জাহাঙ্গীরনগরের অতিথি। ছবি: হাসিবুর অলি

শীতে স্নিগ্ধ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সবুজে ঘেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শীত আসে রাজকীয়ভাবে। একে তো আশপাশের এলাকাগুলোর তুলনায় ক্যাম্পাসে শীত একটু বেশিই অনুভূত হয়, তার ওপর শীতকালজুড়ে রোজই হয় কোনো না কোনো উৎসব, অনুষ্ঠান। সব মিলিয়ে শীত ক্যাম্পাসটাকে একেবারে ‘জমিয়ে’ রাখে।
শীত এলেই সুদূর সাইবেরিয়া থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি চলে আসে ক্যাম্পাসের লেকগুলোতে। অতিথিদের কলকাকলিতে মুখর থাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ। পাখি দেখতে ঢল নামে মানুষেরও। শুধু এই পাখি দেখার জন্য দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসেন অনেকে। অবশ্য পরিবেশবিদেরা মনে করেন, মানুষের ভিড়ের কারণে কয়েক বছর ধরে অতিথি পাখি আসার সংখ্যা কমে গেছে।
পাখি উৎসব, নাট্যোৎসব, নাট্যপার্বণ, কনসার্ট, পুনর্মিলনীসহ নানা উৎসবে শীতকালজুড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মুখর থাকে। সব মিলিয়ে শীতকালের জাহাঙ্গীরনগর এক অন্য জগৎ।
আবদুল্লাহ মামুর

ক্যাম্পাসে অভ্যর্থনা জানায় কৃষ্ণচূড়া। ছবি: দীপু মালাকার
ক্যাম্পাসে অভ্যর্থনা জানায় কৃষ্ণচূড়া। ছবি: দীপু মালাকার

এই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
গাছপালায় ঘেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সব সময় সুন্দর। কদিন আগে শুরু হলো নতুন বছর। ‘এসো হে বৈশাখ’ গেয়ে, মঙ্গল শোভাযাত্রায়, নাচে, গানে ক্যাম্পাসে বৈশাখ বরণ করা হয় বলেই কি না কে জানে, এই সময়টাতে যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরও বেশি সুন্দর দেখায়।
টিএসসি থেকে ভিসি চত্বরের দিকে হাঁটতে থাকবেন। মনে হবে রাস্তার পাশের কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো আপনাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। আবার কলাভবনের দিকে পা বাড়ালে রাস্তাটাকে মনে হয় কৃষ্ণচূড়া বিছানো লালগালিচা। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের পাশে গিয়েও চোখে পড়ে ‘কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে আগুন লেগেছে’। কৃষ্ণচূড়ার প্রতিবেশী সোনালু ফুলগুলো আকাশের ক্যানভাসে নতুন রং যোগ করে।
চৈত্রের শেষ দিকে টিএসসি থেকে শহীদ মিনারে যেতে নাকে আসবে সুমিষ্ট ঘ্রাণ। আমের মুকুল ফুটেছে যে। মাতাল করা সে ঘ্রাণে হারিয়ে শিক্ষার্থীদের মনে পড়ে যায় শৈশবের কথা। বন্ধুরা মিলে রাতের বেলা ক্যাম্পাসের আম পাড়তে বের হন অনেকে। সে এক অভিযান বটে! কাঁচা আম লবণ মেখে খাওয়ার সময় তো এটাই। গ্রীষ্মে পুরো ঢাকা যখন তপ্ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখলে এখানকার বাতাস মন ভালো করে দেয়।
হুটহাট নামে বৃষ্টি। বৃষ্টির সময় যদি কার্জন হলের পুকুরের সামনে থাকেন, তাহলে আপনি সৌভাগ্যবান। পুকুরের পানিতে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে। টিএসসিতে দাঁড়িয়ে দেখা বৃষ্টিও অন্য রকম। হয়তো প্রখর রোদে, টিএসসির আড্ডায় ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ আকাশ অন্ধকার। টুপ করে এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল চায়ের কাপে। তাতে চায়ের স্বাদ বাড়ে কি না জানা নেই, তবে মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। এসব মিলিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রাণের ক্যাম্পাস।
সঞ্জয় সরকার

শরতের আকাশে সাদা মেঘের ভেলা
শরতের আকাশে সাদা মেঘের ভেলা

শরতে সুন্দর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ফুল, ফল, ফসল...কী নেই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ক্যাম্পাসে! তাই ঋতু বদলের বার্তা খুব ভালোভাবেই টের পান এখানকার শিক্ষার্থীরা। ময়মনসিংহে এলে অনেকেই বেড়াতে আসেন নয়নাভিরাম বাকৃবি ক্যাম্পাসে। ১ হাজার ২০০ একরের ক্যাম্পাসটাই তো এক টুকরো বাংলাদেশ!
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শরতের রূপটা অন্য রকম। বর্ষার টানা বর্ষণের পর এ সময় পুরো ক্যাম্পাস ধুয়েমুছে নতুন রূপে সাজে। শিউলি ফুলের উদাস করা ঘ্রাণ, ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে কাশফুলের শুভ্র সমারোহ...শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারেন, এসে গেছে শরৎ! অনুষদ ভবন, হল, খামার ও গবেষণাগারের সামনে ফুটে থাকা শেফালি, মালতী, জুঁই, টগর, কামিনী ফুল শরতের সৌন্দর্য উপভোগের নিয়ামক হয়ে ওঠে। এ সময় অবধারিতভাবেই শিক্ষার্থীদের বিশ্রাম, বিনোদন ও সময় কাটানোর গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি হবে ক্যাম্পাসের সীমানা ঘেঁষে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্রের পাড়। তীরের সাদা কাঁশফুল আর আকাশে সাদা মেঘের ভেলার অপরূপ মিতালি সারা দিনের ক্লাস-পরীক্ষার ক্লান্তি দূর করে দেয়। জ্যোৎস্না রাতে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে গিটার হাতে গান গাওয়া, আড্ডা কিংবা পাড় ঘেঁষে হেঁটে বেড়ানোর মধ্যে শিক্ষার্থীদের শরতের আনন্দ আরও বেড়ে যায়।
শাহীদুজ্জামান সাগর

উরুন–গাইনে ধান ভেনে হয় উৎসবের উদ্বোধন। ছবি: সংগৃহীত
উরুন–গাইনে ধান ভেনে হয় উৎসবের উদ্বোধন। ছবি: সংগৃহীত

সরকারি আজিজুল হক কলেজের নবান্ন উৎসব
ছয় বছর ধরে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করছে কলেজ থিয়েটার। থিয়েটারের কর্মীরা তো বটেই, কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও এই উৎসবের জন্যই হেমন্তের অপেক্ষায় থাকেন। ষোলো আনা বাঙালিয়ানায় পালিত হয় নবান্ন উৎসব। উরুন-গাইনে ধান ভানা, কলা পাতায় নতুন ধানের পিঠা ও ক্ষীর পরিবেশনের মাধ্যমে হয় উদ্বোধন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে গুণীজনেরা আসেন। শিক্ষক ও অতিথিরা তাঁদের বক্তব্যে তুলে ধরেন লোকজ সংস্কৃতি ও নবান্নের তাৎপর্যের কথা। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, সবাই এই দিনে শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে আসেন। পুরো ক্যাম্পাসে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ টের পাওয়া যায়।
উদ্বোধনের পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। বাউল গানের আয়োজনে প্রাধান্য পায় সব দেশীয় বাদ্যযন্ত্র-একতারা, দোতারা, খঞ্জনি, ঢোল...। থিয়েটারের কর্মীরা মঞ্চে নাটক করেন। নাটকের ক্ষেত্রেও নবান্নের গল্পকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়।
মো. সিজুল ইসলাম

বৃষ্টিভেজা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ অন্য রকম। ছবি: জয় পাল
বৃষ্টিভেজা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ অন্য রকম। ছবি: জয় পাল

বৃষ্টিতে অপরূপ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
পাহাড়ে ঘেরা ক্যাম্পাস। চারদিকে সবুজের সমারোহ। পত্রপল্লবের গা ছুঁয়ে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। টুপটাপ শব্দে বৃষ্টি আছড়ে পড়ে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝিরিতে। জলের স্রোতে ঝরনা ফিরে পায় তার যৌবন। এভাবে বর্ষার আগমনে নবরূপে সাজে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রকৃতি। দাবদাহে দগ্ধ ঝুলন্ত সেতুর কাঠগুলো সিক্ত হওয়ার সুযোগ পায় বৃষ্টির বদৌলতে। মাঝেমধ্যে জীববিজ্ঞান অনুষদের করিডরে দেখা মেলে ঝিরি থেকে উঠে আসা শামুক ও কেঁচোদের। হয়তোবা শামুক এবং কেঁচোরাও ব্যবহারিক ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে চায়!
পাহাড়ের পাদদেশে দেখা হতে পারে সাপের সঙ্গে! ঝুমবৃষ্টিতে মাটির ঘ্রাণের সঙ্গে মেশে ঝুপড়ি থেকে ভেসে আসে খিচুড়ির ঘ্রাণ। সঙ্গে একদল শিক্ষার্থী যদি গিটার হাতে শুরু করেন গান, তাহলে তো কথাই নেই। গিটারের টুংটাং আর বৃষ্টির টুপটাপ মিলে সে এক আশ্চর্য যুগলবন্দী। বৃষ্টির সঙ্গে খিচুড়ি আর গান, আর কী চাই! মুষলধারে বৃষ্টি উপেক্ষা করেও কাঁটা পাহাড়ের রাস্তায় হাঁটেন শিক্ষার্থীরা। উদ্দেশ্য শাটল ট্রেন। আগামীকাল আবারও ফিরে আসার প্রত্যয় নিয়ে নৈসর্গিক এই ক্যাম্পাসকে নীরব করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে শাটল ট্রেনে চলে যায় শহরের পানে।
শাহাদাত হোসেন

ফুলের বাগানে সেলফি। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
ফুলের বাগানে সেলফি। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

বসন্তে রঙিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
বসন্তের শুরুতেই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগতে শুরু করে রঙের ছোঁয়া। ডালিয়া, জিনিয়া, কসমস, গাদা, দোপাটি, চামেলিসহ বিভিন্ন ফুলের সুবাসে মুখরিত হয় চারপাশ। বছরের শুরুতেই লাগানো হয় হরেক রকম গাছ, যা বসন্তে ফুলে ফুলে সুশোভিত হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতেই শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ প্রশাসন ভবনের সামনের অংশটাকে একটা ছোটখাটো বাগান মনে হবে যে কারও কাছে। উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে ও বাইরে, হল এবং একাডেমিক ভবনগুলোর সামনেও দেখা যায় নানা প্রজাতির ফুল। এই মনোরম পরিবেশ শিক্ষার্থীদের যেমন চনমনে করে তোলে, একই সঙ্গে আকৃষ্ট করে দর্শনার্থীদেরও। খুলনা শহরের মানুষ বিকেলে একটু প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে চলে আসে এই ক্যাম্পাসে। দেশের অন্যান্য প্রান্ত ও বিদেশ থেকে থেকে আসা পর্যটকেরাও খুলনায় এলে একবার বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে যেতে ভোলেন না। অনেকে ফুলের সঙ্গে ছবি তোলেন। সেই ছবি চলে যায় ফেসবুকে। কাউকে বলে দিতে হয় না, বসন্ত এসে গেছে!
নাবিলা কবির