তৈরি হচ্ছে দক্ষ জনবল

এসএসসি পাসের পরই এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ আছে। ছবি: খালেদ সরকার
এসএসসি পাসের পরই এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ আছে। ছবি: খালেদ সরকার

গৃহস্থালির তৈজস থেকে শুরু করে বড় বড় স্থাপনা তৈরিতেও গ্লাস ও সিরামিকজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। ক্রমশ বাড়ছে চাহিদা। আগে বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও এখন দেশেই এসব পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। আর এ কারণেই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজন হচ্ছে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবলের, যেখানে বড় ভূমিকা রাখছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গ্লাস অ্যান্ড সিরামিকস। গ্লাস ও সিরামিক বিষয়ে ডিপ্লোমা প্রকৌশল পড়ার সুযোগ আছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় দেশে ৪৯টি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট আছে। এর মধ্যে একটি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গ্লাস অ্যান্ড সিরামিকস।

এসএসসি পাসের পরই চার বছর মেয়াদি এই কোর্সে ভর্তি হওয়া যায়। ঢাকার তেজগাঁওয়ে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটিতে পড়তে দেশের নানা জেলা থেকে ছাত্রছাত্রীরা আসে। বিষয় দুটিতে ভর্তি হতে হলে ছেলেদের ক্ষেত্রে সাধারণ গণিত বা উচ্চতর গণিতে কমপক্ষে জিপিএ-৩সহ ন্যূনতম ৩.৫ এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম জিপিএ-৩ পেয়ে এসএসসি উত্তীর্ণ হতে হবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। আবেদন করা যাবে ৩১ মে পর্যন্ত।

পড়ালেখার মান, নিয়মশৃঙ্খলা, পরিবেশসহ নানা বিষয়ের খোঁজ নিতে গত ৫ মে হাজির হই প্রতিষ্ঠানটির ক্যাম্পাসে। মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ল একটি নোটিশ বোর্ড। সেখানে ‘ছাত্র কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ নামে শিক্ষার্থীদের গড়া একটি সংগঠনের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে লেখা আছে সামাজিক সচেতনতামূলক কিছু কর্মসূচির কথা। বিস্তারিত জানা গেল এই সংগঠনেরই সদস্য গ্লাস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চতুর্থ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী নাজিম ইসলামের কাছ থেকে। তিনি বলেন, সংগঠনটির যাত্রা এ বছরই শুরু হয়েছে। এটি মূলত বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি পালন, অসুস্থদের সেবাদান, গরিব শিক্ষার্থীদের আবাসিক সহায়তা প্রদানসহ দেশের যেকোনো দুর্যোগে দুর্গতদের সাহায্য করতে কাজ করে।

 ছয় একর জায়গা নিয়ে নির্মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির চারদিকটা বাহারি রঙের ফুল আর গাছগাছালিতে ঘেরা। নিরিবিলি পরিবেশ। পুরো ক্যাম্পাসটি সিসি ক্যামেরার আওতাভুক্ত। ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রশাসনিক ও একাডেমিক ভবনের মাঝখানে রয়েছে একটি আমগাছ। এটি শিক্ষার্থীদের কাছে আমগাছ চত্বর বলেই পরিচিত। ক্লাসের ফাঁকে এখানে বসে আড্ডা জমান শিক্ষার্থীরা। ইউনিফর্ম পরা একদল ছাত্রছাত্রীকে পাওয়া গেল সেখানে। পরিচয় দিয়ে কাছে যেতেই সিরামিক বিভাগের চূড়ান্ত বর্ষের শিক্ষার্থী নাসির জানালেন তাঁর চার বছরের স্মৃতির কথা। বললেন, ‘ক্যাম্পাসটা আমার কাছে খুব প্রিয়। গত চার বছরে অনেক স্মৃতি জমেছে এখানে।’ সিরাজগঞ্জ থেকে আসা একই বিভাগের শিক্ষার্থী তুষার বললেন, ‘ভিন্ন একটি বিষয় নিয়ে পড়তে এসেছি ভেবে প্রথম দিকে একটু মন খারাপ হলেও এখানকার পড়াশোনার মান, ক্যাম্পাসের পরিবেশ আর শিক্ষকদের আন্তরিকতা দেখে আর খারাপ লাগেনি।’

প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসন ভবনের নিচতলায় রয়েছে লাইব্রেরি। আলমারিতে সাজানো আছে পাঁচ হাজারের বেশি বই। সেখানে কেউ কেউ প্রয়োজনীয় বইটির খোঁজ করছেন, কেউবা ক্লাসের পড়াটা এখানেই সেরে নিচ্ছেন। ঘুরতে ঘুরতে একাডেমিক ভবনে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলার বড় অংশজুড়ে রয়েছে বিশাল ওয়ার্কশপ। গ্লাস বিভাগের একদল শিক্ষার্থীকে দেখা গেল হাতে-কলমে কাজ করছেন। তাঁদেরই একজন সায়েদা আক্তার। একটু আক্ষেপ নিয়ে বললেন, ‘হাতে-কলমে কাজ শেখার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই। যেগুলো আছে, সেগুলোও অনেক পুরোনো।’

এ বিষয়ে গ্লাস বিভাগের প্রধান মো. মাসুদুল হকের বক্তব্য, ‘শুরুতে আমাদের এখানে শুধু সিরামিক বিভাগ ছিল। গ্লাস বিভাগটা চালু হয়েছে ২০০০ সাল থেকে। গত মাসে সরকার একটি প্রকল্পের অনুমোদন করেছে। সেখানে ইনস্টিটিউটের আধুনিকায়নের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করার কথা আমাদের পরিকল্পনায় আছে। এতে শিক্ষার্থীরা আরও ভালো করে হাতে-কলমে কাজ শিখতে পারবে।’

প্রশাসন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে বিভিন্ন বর্ষে ১ হাজার ৫০ জন ছাত্রছাত্রী আছেন। শুরুতে শুধু সিরামিক বিভাগে মাত্র ৪০টি আসন থাকলেও এখন সিরামিক বিভাগে ১৫০ জন এবং গ্লাস বিভাগে ৫০টি আসন আছে। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দুই শিফট চালু রয়েছে। প্রথম শিফট সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে চলে বেলা ১টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত। আর দ্বিতীয় শিফট শুরু হয় ১টা ৩৫ মিনিট থেকে। চলে সন্ধ্যা ৭টা ৪০ পর্যন্ত। চার বছরে মোট ৮টি সেমিস্টারে পড়ানো হয়। প্রতি সেমিস্টারে উভয় বিভাগের শিক্ষার্থীদের ৭টি করে বিষয় পড়তে হয়।

একাডেমিক ভবনের দোতলায় রয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য আধুনিক ক্লাসরুম ও ল্যাব। এ ছাড়া স্কাউটিং, ডিবেটিং, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব ও একটি জব প্লেসমেন্ট সেল আছে। এই সেলের মাধ্যমে পাস করা ছেলেমেয়েদের চাকরির ব্যাপারে সহযোগিতা করা হয়।

ক্যাম্পাস থেকে একটু দূরে ছেলেদের জন্য ‘কবি নজরুল ছাত্রাবাস’ নামে ২৪০ আসনের একটি হোস্টেল-সুবিধা রয়েছে। মেয়েদের জন্য কোনো হোস্টেল নেই, তবে ক্যাম্পাসের ভেতরেই একটি বাংলোতে মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ।

সিরামিক বিভাগের প্রধান বেলায়েত হোসেন জানান, চীন সরকারের বৃত্তি পেয়ে প্রতিবছরই এখান থেকে চার-পাঁচজন শিক্ষার্থী সিরামিকের ওপর প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এ ছাড়া সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা আছে। তিনি বলেন, ‘হাতে-কলমে কাজ শেখার জন্য অষ্টম সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছয় মাসের প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। এ সময় প্রত্যেক শিক্ষার্থী ১৩ হাজার ৫০০ টাকা ভাতা পান। প্রশিক্ষণে ভালো পারফরমেন্স দেখাতে পারলে সেই প্রতিষ্ঠানেই কাজের সুযোগ পাওয়া যায়।’

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল। শিগগিরই নতুন একটি ব্যাচ মুখর করবে এই ক্যাম্পাস। প্রতিষ্ঠানটি এখন তাদেরই অপেক্ষায় আছে।

মো. আইয়ুব আলী, অধ্যক্ষ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গ্লাস অ্যান্ড সিরামিকস
মো. আইয়ুব আলী, অধ্যক্ষ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গ্লাস অ্যান্ড সিরামিকস

শিক্ষার্থীরা বেকার বসে থাকে না

গ্লাস ও সিরামিকের ওপর আমরাই একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেখানে এ দুটি বিষয়ে পড়ানো হয়। আমাদের কোনো ছাত্রছাত্রীকে পড়াশোনা শেষে বেকার বসে থাকতে হয় না। শেষ বর্ষে পড়ার সময়ই অনেকে কাজের সুযোগ পেয়ে যান। তবে দেশে এই বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ নেই বলে ছেলেমেয়েদের মনে একটা হতাশা আছে। ইতিমধ্যে আমরা সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। পাস করার পর ওরা যেন বিএসসি করার সুযোগ পায়, সে জন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। আমি মনে করি, আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে এই সেক্টরের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল হবে। তাদের আর পেছনে তাকাতে হবে না।