সুস্ময়ের সুসময়

পড়ালেখায় ভালো। সুন্দর গান করেন। বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত আছেন। ভদ্র, নম্র হিসেবেও তাঁর সুনাম আছে। সব দিক মিলিয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র শাহ্ মো. নিশতার জাহানকে বলা যায় একদম ‘গুড বয়’!

মেডিকেলের পড়া তো সহজ কম্ম নয়। একটার পর একটা পরীক্ষা চলতেই থাকে। পড়ার চাপ নিশতারকে নিস্তার দেয় না। তবু এর ফাঁকে গান কম্পোজিশনের কাজ করেন তিনি। তাঁর নিজের করা গান আছে মোট ২৩টি। কখনো নিজে লিরিক লেখেন, আবার বন্ধুদের লেখা গানেও সুর বসান। ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোর পরিচিত মুখ এই তরুণ। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা যাঁকে চেনেন সুস্ময় নামে।

গানের জগতের সঙ্গে পরিচয় গড়ে উঠেছে পরিবার থেকে। দিনাজপুর বড় হয়েছেন। সুস্ময় বলছিলেন, ‘আমার বাবা শাহজাহান শাহ্ একজন নাট্যকার, অভিনেতা, গবেষক ও সমাজসেবক। মা-ও খুব গানপ্রিয় মানুষ। নিজেকে এই বৃত্তের বাইরে কখনো ভাবিনি।’ ২০০৩ বা ২০০৪ সালের কথা, গান শেখার জন্য সুস্ময়কে পাঠানো হয়েছিল দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান নবরূপীতে। তখন নাকি গান শিখতে তাঁর একটুও ভালো লাগত না। সুস্ময় বলেন, ‘সত্যি বলতে মনের বিরুদ্ধেই আমি আর আমার ভাই গান শিখতে যেতাম। কিছুই বুঝতাম না। মন পড়ে থাকত ক্রিকেটে। বুধবার বিকেলে হতো আবৃত্তির ক্লাস। শুরুটা অনিচ্ছায় হলেও কখন যে একটু একটু করে গানকে ভালোবেসে ফেলেছি, টের পাইনি।’

গানের পাশাপাশি নাটকের জগতেও সরব সুস্ময়। কখনো অভিনয় করেছেন, কখনো পেছন থেকে করেছেন নাটকের শব্দ বা আবহ সংগীতের কাজ। স্মৃতির ঝুলিতে আছে প্রায় ৩০টি মঞ্চায়নের সন্ধ্যা, নানান কর্মশালার কথা, বাংলাদেশ টেলিভিশনে শুটিং করার মুহূর্ত। বাদ পড়েনি পথনাটক। নাটকের গল্প করতে করতে প্রথম মঞ্চনাটকের অভিজ্ঞতা বললেন। ‘বাবা তখন নবরূপীর সাধারণ সম্পাদক। তাঁর হাত ধরেই নাট্য বিভাগে শিশুশিল্পী হিসেবে শুরু করি। ৩ মাস টানা মহড়ার পর মঞ্চস্থ হয়েছিল মমতাজউদ্‌দীনের শিশু-নাটক তরুকে নিয়ে গল্প। নাটকে আমি মুখ্য চরিত্র তরুর ভূমিকায় ছিলাম।’

ছোটবেলায় নাকি তাঁর চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছে ছিল না। চেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা কিংবা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য নিয়ে পড়বেন। আঁকাআঁকিটা খুব ভালো না পারলেও আগ্রহ ছিল। উচ্চমাধ্যমিকের পর যখন ভর্তিযুদ্ধে নামলেন, প্রথমে অসহায় লাগছিল। সুস্ময় বলেন, ‘খুঁজেই পাচ্ছিলাম না, আমি আসলে কী হতে চাই। মা-বাবার ইচ্ছা ছিল আমি ডাক্তার হব। চেষ্টা করলাম। হয়ে গেল।’

মেডিকেলে পড়ার পাশাপাশি গানবাজনা চালিয়ে যাওয়াটা বেশ কঠিন। সেটা মেনে নিয়েই সুস্ময় বললেন, এটা অসম্ভব নয়। তবে তাঁর নাকি মাঝেমধ্যে আফসোস হয়। বলছিলেন, ‘মেডিকেলে ক্যাম্পাসজীবনকে হেয় করে বলছি না। কিন্তু আমাদের পড়ার যে চাপ, সংস্কৃতিচর্চার খুব একটা সুযোগ আসলে হয় না। পড়ার চাপের কাছে হার মেনে কত শিল্পী যে এখানে হারিয়ে যায়।’

মঞ্চে গান গেয়েছেন বহুবার। সেসবের মধ্যে সেরা মুহূর্তটার কথা জানতে চাই। ‘২০১৬ সালের শেষ দিকের কথা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটরিয়ামে শিরোনামহীন ব্যান্ড এসেছিল। তারা মঞ্চে ওঠার আগে আমি স্বরচিত গান “বুক পকেটের কথা” গেয়েছিলাম সেদিন। এখনো মনে পড়ে, সামনের হাজারখানেক মানুষ তাঁদের মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে হাত নাড়ছিলেন। মঞ্চ থেকে মনে হচ্ছিল, ওগুলো একেকটা জোনাকি।’

নিজের শিকড় নিয়ে মাঝেমধ্যেই ভাবেন সুস্ময়। বলছিলেন, ‘যদি আলাদিনের দৈত্য এসে আমাকে কিছু চাইতে বলত, চাইতাম—আমরা মানুষেরা যেন শিকড় কখনো ভুলে না যাই। মনুষ্যত্বের চর্চা যেন আমাদের মধ্যে থাকে।’

গান-নাটক ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠনে কাজ করছেন তিনি। স্কুলে থাকাকালীন বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্বাধীন’। এ ছাড়া ছিলেন দিনাজপুর ম্যাথ ক্লাব ও দিনাজপুর সায়েন্স ক্লাবের স্বেচ্ছাসেবক। বর্তমানে ‘মেডিসিন ক্লাব-ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ইউনিট’-এর প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন।

ভবিষ্যতে গানের সঙ্গে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু? ভেবেছিলাম, প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ভাবনায় পড়ে যাবেন সুস্ময়। তবে তাঁর ঝটপট জবাব শুনে মনে হলো, উত্তরটা তৈরিই ছিল। ‘ময়মনসিংহে এসে আমি অনেক কিছু শিখেছি। পাশাপাশি কান্না আর আনন্দের জোয়ার বইতে দেখেছি। পেশা হিসেবে ডাক্তারি বেছে নিয়েছি। সংগীত ও সুরকে পাশে রেখে বাকি জীবনটা মানুষের সেবা করতে চাই।’