এমবিএ: হুজুগে না প্রয়োজনে?

স্নাতক শেষ হলেই এমবিএ (মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) ডিগ্রির পেছনে ছোটা একরকম ‘ট্রেন্ড’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই ডিগ্রি আসলে কার জন্য প্রয়োজন? কখন, কেন করবেন এমবিএ? লিখেছেন ব্যবসায় যোগাযোগ পরামর্শক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক সাইফ নোমান খান

প্রতিবছর ঠিক কতজন শিক্ষার্থী এমবিএ শুরু করেও ঝরে পড়েন, এর কোনো পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সংখ্যাটা নিশ্চয়ই আমাদের অবাক করবে। আমার শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেককে দেখেছি, প্রকৌশলে পড়ে এমবিএতে ভর্তি হন। দু-একটা সেমিস্টার শেষে কেন যেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কিংবা হয়তো বুঝতে পারেন, এমবিএ ডিগ্রি তাঁর জন্য নয়।
সাধারণত আমরা মনে করি, যাঁরা দক্ষ ব্যবস্থাপক হতে চান কিংবা যাঁরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী পদে কাজ করতে চান, তাঁরাই এমবিএ ডিগ্রি নেন। আমাদের দেশে প্রেক্ষাপটটা একটু ভিন্ন। শেখার জন্য নয়, স্রেফ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্য কেউ কেউ এমবিএতে ভর্তি হন। অনেকের কাছে এটা নিছক একটা ডিগ্রি, সিভিতে যোগ করার মতো আরও একটা উপাদান। সত্যিই কি তাই? পদার্থবিজ্ঞানে পড়ে কেউ এমবিএ করছেন, আবার কেউ আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পড়ে এমবিএ করছেন—সবার লক্ষ্য যেন ছয় অঙ্কের বেতন! কিন্তু শুধু ভালো বেতন কিংবা আকর্ষণীয় পেশার জন্য এমবিএ করা বোধ হয় ভুল হয়ে যাবে।
এমবিএ করার এই হুজুগ তৈরির পেছনে দায় যে শুধু শিক্ষার্থীদের, তা নয়। অনেক প্রতিষ্ঠান যেকোনো পদের ক্ষেত্রেই বিজ্ঞাপনে লিখে দেয়, এমবিএ ডিগ্রি থাকতেই হবে। অথচ এমবিএ কিন্তু সব পদের জন্য নয়। ডিগ্রির চেয়ে কারিগরি জ্ঞানকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এমবিএ ডিগ্রি থাকলেই যে একজন ভালো কর্মী হবেন, এর তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।

এমবিএ কাদের জন্য?
কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কিংবা নির্বাহী পর্যায়ে কাজ করতে চাইলে এমবিএ একটি কার্যকর ডিগ্রি হতে পারে। তাই বলে স্নাতক যে বিষয়েই হোক, স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশোনাটা যে ‘ব্যবসায় প্রশাসন’ নিয়েই হতে হবে, তা নয়। কয়েক বছর কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করুন। পেশাজীবন কোন পথে এগোচ্ছে, সেটা বুঝুন। তারপর সিদ্ধান্ত নিন। এমবিএ যেহেতু একটি ব্যবহারিক ডিগ্রি, অনেকে প্রতিযোগিতামূলক পড়াশোনার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন না। মাঝপথে পড়া ছেড়ে দেন। চাকরির পাশাপাশি এমবিএ করতে চাইলে আপনি ঠিকমতো সময় দিতে পারবেন কি না, সেটাও বিবেচনা করুন।

এমবিএ কখন করবেন?
ভারতে এমবিএর শিক্ষার্থীদের গড় বয়স ২৭ বছর। দেখা গেছে, ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী ভারতীয়দের মধ্যে এমবিএ ডিগ্রি অর্জনের আগ্রহ বেশি। আবার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট আহমেদাবাদে এমবিএ প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের গড় বয়স ৩৪, তার ওপর ভর্তির জন্য সাড়ে ১০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এমবিএ পড়ুয়াদের গড় বয়স ২৭-২৮ বছর। গত কয়েক বছরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা এমবিএর জন্য ভর্তি হয়েছেন, তাঁদের গড় বয়স ২৭। অনেক বিজনেস স্কুলেই এমবিএ ডিগ্রির জন্য ভর্তি হতে হলে ৩ থেকে ৪ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়।
অথচ বাংলাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায়, ম্নাতক (সম্মান) পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেই এমবিএর ক্লাস শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এমবিএ ডিগ্রির মূল লক্ষ্য শুধু ডিগ্রিই নয়, কাজের অভিজ্ঞতাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সহজ করে বললে, এটি পেশাজীবনকে এক ধাপ এগিয়ে নেওয়ার একটা কার্যকরী মাধ্যম হতে পারে।
সব শেষ কথা এই—সবাই এমবিএ করছে, তাই আমারও করা দরকার; এমন ভাবনা থেকে কখনোই এমবিএ শুরু করবেন না। স্নাতকে আপনি কোন বিষয়ে পড়েছেন, কোন ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার গড়তে চান, এসব মাথায় রেখে পা বাড়ান।

এমবিএ সম্পর্কে ৪টি ভুল ধারণা
১. এমবিএ না করলে চাকরি হবে না
এ ধারণা একেবারেই ভুল। এমবিএ না করেও আপনার যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী কাজ করতে পারেন। এমবিএ একটি বিশেষায়িত ও পেশাদার ডিগ্রি। আপনি এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করলেই চাকরি নিশ্চিত করতে পারবেন না। স্নাতক পেরোনোদের মতোই চাকরির আবেদনের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে আপনাকে সামনে এগোতে হবে।

২. এমবিএ ডিগ্রিতে বেতন বাড়ে
এ ধারণা সব সময় ঠিক নয়। আপনি এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করলেই যে ভালো বেতন পাবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর চেয়ে কাজে দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা বেতন বাড়াতে বেশি কার্যকর।

৩. এমবিএ ডিগ্রি পেশা বদলের ধাপ
আপনি হয়তো চিকিৎসাবিজ্ঞানে বা প্রকৌশলে পড়ছেন কিন্তু কাজ করতে চান বিপণন ক্ষেত্রে বা বহুজাতিক কোনো প্রতিষ্ঠানে। পেশা বদলের জন্য যদি এমবিএ ডিগ্রির ওপর ভরসা করেন, তাহলে ভুল হবে। হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা অর্জনের পর ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে কাজের ক্ষেত্রে এমবিএ একটি কার্যকর ডিগ্রি।

৪. এমবিএর বিকল্প নেই
করপোরেট চাকরির ক্ষেত্রে এমবিএর বিকল্প নেই, এমনটাও অনেকে ভাবেন। কিন্তু কাজ কিংবা স্নাতকের বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আপনি কিন্তু অন্য কোনো বিষয়েও স্নাতকোত্তর বা ভিন্ন ডিগ্রি নিতে পারেন। যেমন ফিন্যান্সের ছাত্ররা অনেকে চার্টার্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট (সিএফএ) ডিগ্রি নেন।