দেশ-বিদেশের বিতার্কিকেরা বাংলাদেশের মঞ্চে

হাই স্কুল বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ডিবেট নেটওয়ার্ক নেপাল। ছবি: সংগৃহীত
হাই স্কুল বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ডিবেট নেটওয়ার্ক নেপাল। ছবি: সংগৃহীত

ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের মূল ফটক দিয়ে ভেতরে পা রাখতেই চোখে পড়ল আজব একটা গাড়ি। অদ্ভুত আকৃতির, কিন্তু খুব চেনা! ভাবতে ভাবতে যখন পা বাড়িয়েছি, তখনই মনে পড়ল, আরে! এ তো ব্যাক টু দ্য ফিউচার সিনেমার সেই ‘ডেলরিয়ান টাইম মেশিন’।

ব্যাক টু দ্য ফিউচারকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলাম ক্যাম্পাসের মিলনায়তনের দিকে। সেখানে তখন জমে উঠেছে বিতর্কের মঞ্চ। চলছে ‘হাই-স্কুল’ বিভাগের ফাইনাল। মুখোমুখি লড়ছে চারটা দল। তার মধ্যে তিনটাই বাংলাদেশের। আরেকটা দল নেপালের। নিচতলায় বাংলাদেশ বনাম নেপালের কথার লড়াই যখন হাড্ডাহাড্ডি পর্যায়ে, ঠিক তখন তিনতলায় চলছে ‘উন্মুক্ত’ বিভাগের ফাইনাল পর্ব। কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন নিয়ে বিতর্ক করেছিল তিন দেশের চারটি দল। মালয়েশিয়া আর ভারতের দুটি, বাকি দুটি দল বাংলাদেশের।

নানা দেশের বিতার্কিকেরা এক হয়েছিলেন ‘আইইউবি অ্যাসেনশন ২০১৮’-এর আয়োজনে। আন্তর্জাতিক এই বিতর্ক টুর্নামেন্ট ২০ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে শেষ হলো ২২ সেপ্টেম্বর। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ডিবেটিং ক্লাব (আইইউবিডিসি) এই মহাযজ্ঞের আয়োজক।

গতবারের তুলনায় এবারের আয়োজনটা হয়েছে বড় কলেবরে। তুলনামূলকভাবে বেড়েছে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা। ‘গত বছর ৮৪টি দল অংশগ্রহণ করলেও এ বছর তিনটি বিভাগে ১১৬টি দল বিতর্ক করেছে। এর মধ্যে ১৯টি দল এসেছে দেশের বাইরে থেকে,’ জানালেন আয়োজনের আহ্বায়ক অর্চি অনন্যা।

আইইউবি ডিবেটিং ক্লাবের সভাপতি জুবাইর রিদওয়ান বলেন, ‘অংশগ্রহণের দিক থেকে এশিয়ার সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করার ইচ্ছা ছিল আমাদের। এশিয়ার সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট এবিপিতে এবার অংশগ্রহণ করেছে ১০৮টি দল। সে হিসাবে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছি।’ জানা গেল, শুধু ভিনদেশি বিতার্কিকদের দলই নয়, বরং নেপাল, মালয়েশিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়াসহ আরও বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীর সঙ্গে এসেছিলেন ২৫ জন ভিনদেশি বিচারকও।

ইংরেজি ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি ফরম্যাটে আয়োজন করা হয় ‘অ্যাসেনশন’। অর্চি বলেন, প্রথম দুই দিনে দলগুলোর মধ্যে ছয় রাউন্ড বিতর্ক হয়েছে। এরপর সবচেয়ে বেশি পয়েন্টপ্রাপ্ত দলগুলো চলে গেছে নকআউট পর্বে। ‘উন্মুক্ত’ বিভাগে নকআউট পর্বে লড়াই করেছে ২৪টি দল, ‘হাইস্কুল’ বিভাগে সংখ্যাটা ১৬। আর ‘নবীন’ বিভাগে ৪টি দল সরাসরি ফাইনালে জায়গা করে নেয়।

কিন্তু শুরুতেই দেখা ওই গাড়িটার তো কোনো সুরাহা হলো না। আবার বেরিয়ে পড়া যাক। খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করার পর বুঝতে বাকি রইল না, আইইউবি এবার সেজেছে ‘সায়েন্স ফিকশন’-এর সাজে। টুর্নামেন্টে যাঁরা গিয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই দেখা হয়েছে ‘স্টার ওয়ার্স’-এর বিখ্যাত চরিত্র ‘স্টর্মট্রুপার’-এর সঙ্গে। তর সইতে না পেরেই কি না কে জানে, উদ্বোধনের মঞ্চে উঠে খানিকক্ষণ নাচতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। মঞ্চে আরও ছিল সাই-ফাই ছবির আরেক বিখ্যাত চরিত্র ‘ওয়াল-ই’। সব মিলেমিশে যেন সত্যিই সায়েন্স ফিকশনের জগতে চলছিল যুক্তির লড়াই।

তিন দিনের এই উৎসবমুখর বিতর্ক শেষে বিজয়ীর খেতাব জিতল কারা? উন্মুক্ত বিভাগের ফাইনালে বাংলাদেশের দুটি দলকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দিল্লি ইউনিভার্সিটি, আর রানার্সআপ খেতাব পেয়েছে মালয়েশিয়ার টেইলর ইউনিভার্সিটি। হাইস্কুল বিভাগেও চ্যাম্পিয়নের ট্রফিটা দেশে রাখা যায়নি। স্বাগতিক তিন দলকে হারিয়ে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ডিবেট নেটওয়ার্ক নেপাল। আর রানার্সআপ ঢাকার রাজউক কলেজ। এই দুই বিভাগে চ্যাম্পিয়নের ট্রফিগুলো দেশের বাইরে চলে গেলেও নবীন বিতার্কিকদের বেলায় ঘটনা ভিন্ন। এই বিভাগে কাঠমান্ডু ইউনিভার্সিটি স্কুল অব ল’কে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি ছিনিয়ে নিয়েছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

কথা হলো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দলের সদস্য অসিত কুমার দত্তের সঙ্গে। উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলেন, ‘খুলনা অঞ্চলে বিতর্কের চর্চাটা ঢাকার মতো এত ব্যাপক পরিসরে হয় না। এ রকম একটা অবস্থান থেকে নিজেদের প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেই চ্যাম্পিয়ন হব, কল্পনাও করিনি।’

আন্তর্জাতিক কোনো টুর্নামেন্ট আয়োজনের সঙ্গে দেশের দলগুলোর মানের নিবিড় সম্পর্ক আছে বলে বিশ্বাস করেন রিদওয়ান। ‘একটা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট মানে শুধু ভালো দলের সঙ্গে লড়াই করা নয়। বরং আন্তর্জাতিক বিচারকদের সামনে বিতর্ক করারও একটা সুযোগ। আর বিতার্কিকদের মূল প্রতিযোগিতা কিন্তু এই আন্তর্জাতিক অঙ্গনেই। গতবার ‘অ্যাসেনশন’ আয়োজনের পরপরই বাংলাদেশের একটা দল এবিপি জিতল, এই কিছুদিন আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ইউএডিসি চ্যাম্পিয়ন হলো। এগুলো সবই নিয়মিত আন্তর্জাতিক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ফল,’ বললেন তিনি।

আন্তর্জাতিক মানের আয়োজনের জন্য চাই সে রকম আতিথেয়তা। টুর্নামেন্টের অন্যতম বিচারক ববি আন্দিকা রুইতাংয়ের কথায় ঠিক এ দিকটাই উঠে এল। ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা এই বিচারক বলছিলেন, ‘মানের দিক থেকে আইইউবি অ্যাসেনশন নিঃসন্দেহে দুর্দান্ত একটা টুর্নামেন্ট হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে আয়োজকদের অসাধারণ কর্মদক্ষতার ফলে। শতাধিক দল নিয়ে একটা টুর্নামেন্ট আয়োজন করা মুখের কথা নয়। কিন্তু আইইউবিডিসি তা বেশ চমৎকারভাবে করে দেখিয়েছে।’

ট্রফি-অংশগ্রহণসহ সবকিছুকে ছাপিয়ে ‘আইইউবি অ্যাসেনশন ২০১৮’-এর সার্থকতা অন্য এক জায়গায়। পুরো টুর্নামেন্টের বিভিন্ন রাউন্ডে দেশ-বিদেশের অনেকগুলো দল বিতর্ক করেছে বাংলাদেশের নানা বিষয় নিয়ে। পরের বারের আয়োজন নিয়ে কী ভাবছেন? সভাপতি জুবাইর রিদওয়ান বলেন, ‘আগামীবার কেবল অংশগ্রহণে নয়, বরং সব দিক থেকে একটা বড় মানের টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে চাই। ইউএডিসি, এবিপি সমপর্যায়ের...কিংবা তার চেয়েও বড় করে।’