যেদিন আমরা গ্র্যাজুয়েট হলাম

সমাবর্তনে এ এক চেনা দৃশ্য। ছবি: হাসান রাজা
সমাবর্তনে এ এক চেনা দৃশ্য। ছবি: হাসান রাজা

সমাবর্তনের আমেজ শুরু হয়েছিল আগস্টের শেষে। অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে। ভর্তি বা বেতনের রসিদের মতো দুই হাত লম্বা ফরম পূরণ করতে হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়েই নিবন্ধনের কাজটা করা গেছে। এমনকি টাকা দিতেও ব্যাংকের লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। মোবাইল ব্যাংকিং দিয়ে টাকা জমা দেওয়া গেছে নিমেষেই। সে হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা ভাগ্যবানই বলা যায়।

তারপর সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকেই দেখি খেলার মাঠে সাজসজ্জার কাজ চলছে। পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে সত্যিই শিহরিত হতাম। বহু সমাবর্তনের গল্প শোনা, পড়া বা ভিডিও দেখার পরও কৌতূহল হচ্ছিল, পুরো মাসজুড়েই ছিল অনেক জল্পনা-কল্পনা। রাস্তাঘাটে, হলে, টিএসসিতে—যেখানেই পরিচিত-অর্ধপরিচিত বন্ধুদের দেখেছি, একে অন্যকে জিজ্ঞেস করেছি, সমাবর্তন নিচ্ছ? মাসজুড়ে আমাদের কথার শুরুই ছিল এটা দিয়ে।

নিবন্ধনের সময় আমাদের পাঁচটা ফরম দেওয়া হয়েছিল, প্রিন্ট করে নিতে। একটা ছিল সমাবর্তনের কস্টিউম নেওয়ার। একটা ছিল গিফট ভাউচার। সার্টিফিকেট নেওয়া, গাউন জমা দেওয়ার ফরম আলাদা। দলবেঁধে এই মাসে আমরা ওই সব ফরমে স্যারদের স্বাক্ষর নিয়েছি, হলে জমা দিয়েছি।

৩ অক্টোবর। বুধবার। খেলার মাঠে বিশাল প্যান্ডেল প্রস্তুত। আমরা সবাই গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। কেউ কলাভবনে, কেউ কার্জন হলে, কেউ টিএসসিতে। লম্বা লাইন। লাইনের শুরুতে পৌঁছালে আমাদের একটা কালো গাউন, একটা গ্র্যাজুয়েশন ক্যাপ, একটা টাই দেওয়া হলো। তারপরের গল্পটা খুব সোজা। পুরো ক্যাম্পাস আমাদের দখলে। আপনি যদি তখন ক্যাম্পাসে ঢুকতেন, আপনার মনে হতো এক টুকরো ‘হগওয়ার্টস’। দলবেঁধে কালো গাউন পরে ঘুরছে হাজারো শিক্ষার্থী। কেউ গুগল করছে কীভাবে গাউনটা পরতে হবে। কীভাবে ট্যাসেল রাখতে হবে। একদল তর্ক করছে ক্যাপের ট্যাসেল বাঁয়ে থাকবে না ডানে। আর সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছবি তুলছে।

এর আগে কদিন ফেসবুকে তুমুল আলোচনা দেখেছি, সমাবর্তনে কী কী করা যায়। লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে কেউ কেউ। সবার তালিকাতেই ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিময়, ঐতিহাসিক জায়গাগুলোতে সমাবর্তন গাউন পরে ছবি তুলতে হবে। বিশাল ক্যাম্পাস, শহিদুল্লাহ হলের পুকুরপাড় থেকে শুরু করে কার্জন, দোয়েল চত্বর, রাজু ভাস্কর্য, অপরাজেয় বাংলা, ভাস্কর্য চত্বর, টিএসসি, কলাভবন, সিনেট ভবন, চারুকলা, এই তালিকা তো আসলে লিখে শেষ করা যাবে না। ছবি তো তুলতে হবে প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে, ক্লাসরুমে, ল্যাবেও। এতগুলো জায়গায় ছবি তুলতে চাই ফটোগ্রাফার বন্ধু। এবারের সমাবর্তনে সম্ভবত নতুন সংযোজন, প্রায় সবাই বিশেষ দিনটার স্মৃতি ধরে রাখার বন্দোবস্ত করেছে। পেশাদার আলোকচিত্রী তো ছিলই। ভালো মানের ক্যামেরা আছে যেসব বন্ধুর, কদর বেড়েছিল তাদেরও।

সমাবর্তনে আমাদের ডিগ্রি প্রদান করা হবে। এমন চমৎকার মুহূর্তকে স্মরণীয় করতে যোগ দিয়েছেন মা-বাবা, ভাইবোন। অনেকে এসেছে যুগলবন্দী হয়ে। হয়তো এই ক্যাম্পাসেরই কোনো একজন এখন তার জীবনসঙ্গী। সবচেয়ে ভালো লেগেছিল ওই মুহূর্তে, যখন দেখলাম দুজন শিক্ষার্থী সমাবর্তন গাউন পরা এবং সঙ্গে তাঁদের ছোট্ট ছেলেও একটা গাউন পরে এসেছে।

৫ তারিখ বিকেলে সমাবর্তন মাঠ শতভাগ প্রস্তুত। পরদিন সমাবর্তন। সমাবর্তন এমন রাজকীয় ব্যাপার যে আগের দিন তার মহড়া করতে হয়। মহড়ায় অংশ নিল অবশ্য কম শিক্ষার্থীই। সবাই এখানে–সেখানে ঘুরে বেড়াতে ব্যস্ত। অনেকের মা-বাবা আবার জীবনে প্রথমবার ক্যাম্পাসে এসেছেন, তাঁদের উচ্ছ্বাস কোনো অংশেই কম নয় শিক্ষার্থীদের চেয়ে।

৬ তারিখ ভোর থেকেই শিক্ষার্থীরা হাজির ক্যাম্পাসে। কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের গেট খোলা হলো সাড়ে নয়টায়। একে একে নিরাপত্তাবেষ্টনী পার হয়ে ঢুকলাম প্যান্ডেলের ভেতরে। চমকিত হওয়ার মতো ব্যাপার। সামনে বিশাল মঞ্চ। প্যান্ডেলের বিশালত্বই আমাদের মোহিত করল।

মঞ্চের সামনে সুবিধামতো জায়গা করে নিলাম। এরপর শুরু হলো চ্যান্সেলরের শোভাযাত্রা। শিক্ষক, সিনেট সদস্য, সিন্ডিকেট মেম্বার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সমাবর্তন বক্তাকে নিয়ে প্যান্ডেলে প্রবেশ করলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। বেজে উঠল জাতীয় সংগীত। ওই মুহূর্তকে আমি সারা জীবন মনে রাখব। এবার সমাবর্তন নিয়েছে ২১ হাজার ১৪৮ জন শিক্ষার্থী। আমার মনে হয় প্রত্যেকেই মনে রাখবে ওই মুহূর্তটা।

এরপর ডিগ্রি দেওয়া হলো। অনুষদগুলোর ডিনরা শিক্ষার্থীদের উপস্থাপন করলেন আচার্যের কাছে। তিনি ডিগ্রি প্রদান করলেন। প্রথমে দেওয়া হলো পিএইচডিপ্রত্যাশীদের, তারপর এমফিলপ্রত্যাশীদের। শেষে দেওয়া হলো অন্যদের। যারা বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর হলো। রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘ট্যাসেল বাঁ থেকে ডানে যাবে।’ আমরা সবাই গ্র্যাজুয়েশন ক্যাপের ট্যাসেল বাঁয়ে নিলাম। আমরা সবাই গ্র্যাজুয়েট হয়ে গেলাম। এক অদ্ভুত অনুভূতি। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে প্রায় দেড় যুগের শিক্ষাজীবন আমাদের। একটা পূর্ণতা পেল ওই মুহূর্তে।

সমাবর্তনের একটা অনুষঙ্গ তখনো বাকি, সমাবর্তন বক্তৃতা। আমাদের সমাবর্তন বক্তৃতা দিলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। উচ্চশিক্ষা নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন জানালেন, আমাদের জানালেন অভিনন্দন। অভিনন্দন জানালেন আমাদের অভিভাবক এবং শিক্ষকদেরও। তারপর রাষ্ট্রপতির ভাষণ শেষে আমাদের সমাবর্তন শেষ হয়ে গেল।

বাইরে বেরিয়ে এলাম। চারপাশ কালো গাউনের দখলে। কার্জন হলের মধ্যে এসে দেখি সবাই ক্যাপ তুলে ওপরে ছুড়ে মারছে। ছবি তুলছে। অনেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে ছবি তুলছে। অনেকে আবার শুধুই হেঁটে যাচ্ছে। ডান পাশে ট্যাসেল ঝোলানো গর্বিত গ্র্যাজুয়েট। কিছুদিন পরেই হয়তো জীবনযুদ্ধে নেমে পড়বে। এরাই তো দেশের ভবিষ্যৎ। এরাই তো গড়ে তুলবে দেশটা। সমাবর্তন বক্তৃতায় যেমনটা আনিসুজ্জামান স্যার বলেছেন, আমরা যাতে আমাদের ঋণের কথা ভুলে না যাই। গরিব দেশের অল্প কিছু সৌভাগ্যবানের মধ্যে আছি আমরা, যারা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছি।

আজ সমাবর্তন শেষে দলবেঁধে ফরম নিয়ে ঘোরাঘুরির কথা ভাবলে কেমন শূন্যতা কাজ করছে। বন্ধুদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রায় সময়ই আমাদের ঘুরতে হয়েছে এ অফিস থেকে আরেক অফিসে। পরীক্ষার জন্য, বেতন দেওয়ার জন্য, বছর বছর ভর্তির জন্য। মনে পড়ছে টিএসসিতে বসে ভোর হতে দেখা, চার ঘণ্টা পরীক্ষা দিয়ে সন্ধ্যার সময় কার্জনে সূর্যাস্ত দেখা অথবা ক্লাসের ফাঁকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখা চারপাশ অন্ধকার করে প্রচণ্ড ঝড়, ল্যাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে কোনো একটা পরীক্ষণের ফল মেলানোর চেষ্টা। অনেক মুহূর্ত এসে ভিড় করছে। এই লেখা লিখছি বৃহস্পতিবার, ১১ অক্টোবর। আজই গাউন জমা দেওয়ার শেষ দিন। জমা দিলে হাতে লেখা একটা সার্টিফিকেট পাব। সমাবর্তনের মুহূর্তটাকে হারাতে ইচ্ছে হচ্ছে না, তাই গাউনটা জমা দিইনি এত দিন। এখন দিতেই হবে। জমা দিয়ে নিতে হবে বিশাল দায়িত্ব, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির ডিপ্লোমা। তবে আমি একা নই। আমরা ২১ হাজার ১৪৮ জন।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তনে ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি পাওয়া শিক্ষার্থী