'এত বই পৃথিবীর কোনো দেশ ছাপায় না'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে বই উৎসবে উচ্ছ্বাসিত শিক্ষার্থীরা। ঢাকা, ১ জানুয়ারি। ছবি: দীপু মালাকার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে বই উৎসবে উচ্ছ্বাসিত শিক্ষার্থীরা। ঢাকা, ১ জানুয়ারি। ছবি: দীপু মালাকার

সকালের নরম রোদ ধীরে ধীরে তপ্ত হয়ে উঠছে। বিশাল মাঠে পাখিদের মতো কিচিরমিচির করছে অসংখ্য প্রাথমিক-পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে ৷ সঙ্গে আছেন বাবা-মা অথবা বড় ভাই-বোন ৷ সামনে সুন্দর মঞ্চ। বছরের প্রথম দিনে এই খুদে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে নতুন শ্রেণির নতুন বই। মাইক হাতে মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন ছোটদের প্রিয় মানুষ অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এই প্রিয় মানুষ তাদের প্রশ্ন করলেন, 'তোমরা কেমন আছ?' শিশুদের অসংখ্য অস্পষ্ট শব্দের কিচিরমিচিরে আকাশে-বাতাসে দোলা লাগল। বোঝা গেল, তারা ভালো আছে এবং প্রিয় এই মানুষকে পেয়ে তাদের খুশির রাজ্যে ঝড় উঠেছে ৷

জাফর ইকবাল বললেন, ‘আমি তো মাস্টার মানুষ, ছেলে-মেয়েদের দেখলে আমি প্রশ্ন করি। তোমাদের একটা প্রশ্ন করব?' আবারও সেই সপ্রতিভ কিচিরমিচির। প্রশ্ন করলেন, ‘বলো দেখি, বাংলাদেশ কতগুলো বই সমস্ত ছেলে-মেয়েদের দেবে?' উত্তর এল, ৩৩ কোটি ৷ এরপর ছোটদের এই প্রিয় মানুষ বললেন, 'এত বই পৃথিবীর কোনো দেশ ছাপায় না ৷ কোনো দেশ ছাপাতে পারবেও না, শুধু বাংলাদেশ পারবে ৷ এত কষ্ট করে এতগুলি বই কেন ছাপায়, বলো। তোমাদের জন্য। তোমরা বইটা পড়বে তো? সারা পৃথিবীর কোনো মানুষ এত নতুন বই পায় না। বাসায় গিয়ে আজকে রাতেই সবগুলো বই পড়ে ফেলবে, ঠিক আছে?'

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে আজ মঙ্গলবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে 'বই বিতরণ উৎসব ২০১৯' আয়োজন করা হয়। এই উৎসবে বিশেষ অতিথি ছিলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এই আয়োজনে ঢাকা মহানগরের রমনা, ধানমন্ডি, লালবাগ, কোতোয়ালিসহ বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হয়।

আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত না থাকলেও ফোনে আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন। সভাপতিত্ব করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন। স্বাগত বক্তব্য দেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল ৷ বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক, জাতীয় দলের ক্রিকেটার ও বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান ৷

প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'সবাইকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি ৷ আজকের এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমি স্বশরীরে উপস্থিত না থাকতে পারায় দুঃখ প্রকাশ করছি ৷ আশা করি, এই বই উৎসব সার্থক হবে ৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা প্রতি বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও বই উৎসব পালন করছি ৷ এবার প্রায় ৩৮ কোটি বই আমরা সারা দেশে সমস্ত শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছি ৷ শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের মনোযোগ সারা পৃথিবীব্যাপী তাক লাগিয়ে দিয়েছে ৷ আশা করবো, আমাদের শিক্ষার্থীরা নতুন বই পেয়ে পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হবে এবং সরকারের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করে দেশকে স্বাবলম্বী করে তুলবে এবং উপযুক্ত মানুষে হিসেবে গড়ে উঠবে- তাদের কাছে এই প্রত্যাশা রাখি ৷'

খুদে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, 'তোমরা খুবই সৌভাগ্যবান যে তোমরা নতুন বই পাও ৷ আমরা কোনো দিন নতুন বই পাই নাই, সব সময় বড় ভাইদের পুরোনো বই নিতাম ৷ তোমাদেরকে দেখে আমার ঈর্ষা হচ্ছে ৷ কিন্তু খুবই ভালো লাগছে যে বাংলাদেশ এত ভালো হয়েছে, এত বিজয় লাভ করতে পারছে যে আজকে ৩৩ কোটি বই দেওয়া হচ্ছে ৷ হাত তালি দাও ৷ সবাই মিলে বলো, ধন্যবাদ ৷ কারণ আমরা নতুন বই পাচ্ছি ৷ নতুন বই পড়তে তোমাদের ভালো লাগবে না? তোমরা বেশি করে বই পড়বে, বেশি করে খেলাধুলাও করবে ৷ বাংলাদেশে ছেলেরা জেগে উঠেছে, মেয়েরাও জেগে উঠেছে ৷ মেয়েরা বরং ছেলেদের চেয়ে বেশি স্কুলে যায় ৷ এই জন্য আজ থেকে ১০, ২০ বছর পরে বাংলাদেশটা হবে একটা সোনার দেশ, সোনার বাংলা, যার স্বপ্ন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখেছিলেন ৷'

বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান এই খুদে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, 'আশা করি সবাই ভালো আছ ৷ সবাইকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা ৷ তোমরা দেশের ভবিষ্যৎ, তাই তোমাদের হাতে বই তুলে দেওয়াটা সব থেকে বড় কাজ ৷ আমি ধন্যবাদ জানাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে, যার অক্লান্ত পরিশ্রমেই এটা সফল হয়েছে ৷ আশা করি, তোমরা সবাই পড়াশোনায় মনোনিবেশ করবে, সাথে সাথে খেলাধুলাটাও করতে হবে ৷ দুইটা জিনিসই এক সাথে চালাতে হবে এবং সবগুলোতেই ভালো করতে হবে ৷ আশা করি, তোমাদের এ বছরটা অনেক সুন্দর যাবে, ভালোভাবে যাবে ৷'

আয়োজনের সভাপতির বক্তব্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবারও দেশ পরিচালনার জন্য জনগণ ম্যান্ডেট প্রদান করেছে ৷ কেন এই ম্যান্ডেট প্রদান করা হয়েছে? একই দিনে আমরা ৩৩ কোটি বই বিতরণ করছি ৷ প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৷ শুধু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আজকে সারা বাংলাদেশে প্রায় তিন কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে বই বিতরণ করছে ৷ এটি সরকারের একটি অভাবনীয় উদ্যোগ ৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এটি শুরু হয়েছে ২০১০ সাল থেকে ৷ এখন বাংলাদেশের কোনো গ্রাম নাই যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় নাই ৷ আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাচ্ছে ৷ প্রাথমিক শিক্ষার ভিত ও মানকে যদি আমরা শক্তিশালী করতে পারি, তাহলেই কেবল ২০৪১ সালে যে উন্নত বাংলাদেশ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গড়তে চান, সেটি সম্ভব ৷ ২০১৯ সাল হোক আমাদের মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি বছর ৷ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য আগামীকাল থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু হবে ৷'

এই উৎসবের আয়োজকদের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২০১৯ শিক্ষাবর্ষে দেশের ৫০৮টি উপজেলার প্রাথমিক স্তরের ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৪৭টি বিদ্যালয়ের প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে ২ কোটি ৩৯ লাখ ৬৫ হাজার ১৫১ জন শিক্ষার্থীদের হাতে যথাক্রমে ৩৪ লাখ ২৮ হাজার ১০টি করে আমার বই ও অনুশীলন খাতা এবং ৯ কোটি ৮৮ লাখ ৯৯ হাজার ৮২৪টি বই বিতরণ করা হবে ৷ এ ছাড়া, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আওতাভুক্ত প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য মোট ২ লাখ ৭৭ হাজার ৬৮টি পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করা হয়েছে ৷