চলুক উদ্যোক্তা হওয়ার প্রস্তুতি

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান মেলায় অংশ নেওয়ার মাধ্যমেও আইডিয়ার চর্চা হতে পারে। ছবি: প্রান্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান মেলায় অংশ নেওয়ার মাধ্যমেও আইডিয়ার চর্চা হতে পারে। ছবি: প্রান্ত

পড়াশোনা শেষ করে চাকরির বদলে যাঁরা উদ্যোক্তা হবেন বলে ভাবছেন, তাঁদের উচিত কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় থেকেই ছোট পরিসরে নিজের যোগ্যতা এবং চ্যালেঞ্জিং মানসিকতাকে প্রতিনিয়ত ঝালিয়ে নেওয়া। সফলতাকে সব সময় সিঁড়ির সঙ্গে তুলনা করা হয়, লিফটের সঙ্গে নয়। পড়াশোনার পাশাপাশি অনেকে যেমন বিসিএস, ব্যাংকে কিংবা অন্যান্য চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেন, ঠিক তেমনি নিজের একাডেমিক পরিবেশ, ব্যক্তিজীবন কিংবা সামাজিক অবস্থানের মধ্য থেকে প্রতিনিয়ত উদ্যোক্তা হওয়ার প্রস্তুতি নিতে হয়। এককথায় বললে বিষয়টা অনেকটা ক্রিকেটের ফাইনাল ম্যাচ খেলার আগে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার মতো।

কেন নিতে হবে প্রস্তুতি?
একুশ শতকের পৃথিবী অনেক বেশি প্রতিযোগিতাপূর্ণ। আর এই বাজারে টিকে থাকতে হলে নিজের অনভিজ্ঞতার জায়গাগুলোতে অভিজ্ঞতা গড়তে হবে। সবকিছু ঠিক থাকার পরও পৃথিবীতে অনেক অসাধারণ স্টার্টআপের আইডিয়া ব্যর্থ হয়েছে। কেন? উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যায়, বেশির ভাগ ব্যবসাই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে ছিল। এখানেই খেলা শুরু হওয়ার আগে শেষ হয়ে যায়। ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত কখনো অনুমান–নির্ভর নয়; সব ধরনের অংশীদারদের বুঝেশুনে প্রতি কদম ফেলতে হয়। আর কাজটি করার জন্য দরকার ব্যবহারিক জ্ঞান। ছোট পরিসরের কিছু ব্যর্থতা মানুষকে বড় ধরনের শিক্ষা দেয়।

প্রস্তুতির সীমারেখা
প্রস্তুতি একটি বৃহৎ ধারণা। এটির কোনো সীমারেখা হয় না। ব্যক্তির পারিবারিক সহযোগিতা থেকে শুরু করে মানুষের সঙ্গে ব্যবসায়িক লক্ষ্যে সুসম্পর্ক তৈরি করা—সবকিছুই প্রস্তুতির অংশ।
* নেটওয়ার্কিং বা বিভিন্ন মাধ্যমের পেশাজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো ছাড়া যেকোনো আইডিয়াই অচল। একাডেমিক পরিবেশ হোক কিংবা ব্যক্তির সামাজিক পরিবেশ, সব জায়গা থেকেই সব সময় নেটওয়ার্কিংয়ের চেষ্টা করতে হবে। যত বেশি মানুষের সঙ্গে পরিচিতি থাকবে, তত বেশি লাভ। কোনো পরিচিতিই বিফলে যাবে না।
* ব্যক্তিগত দক্ষতা অনেক কিছুর সমন্বয়ে ঘটে। আমরা এমন অনেককে দেখি, যাঁরা জানেন অনেক, কিন্তু প্রকাশ করতে পারেন না। আরও স্পষ্ট একটা উদাহরণ হতে পারে পরীক্ষার হল। একজন হয়তো অনেক কিছু জানেন, কিন্তু তিনি গুছিয়ে লিখতে পারেন না বলে কম নম্বর পান। আবার অল্প কিছু জেনেও গুছিয়ে লেখার দক্ষতার কারণে অনেকে বেশি নম্বর পান। অতএব আপনি নিজে যা বোঝেন, সেটা অন্যকে বোঝানোর দক্ষতাও আপনার থাকতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসার জন্য ভালো ব্যবস্থাপনা জ্ঞান থাকতে হবে, অন্যকে নিজের বাক্শৈলীর মাধ্যমে মুগ্ধ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। দক্ষতা উন্নয়নের কোনো সীমারেখা নেই; এটি ব্যক্তির চেষ্টার সমানুপাতিক।
* ছোট পরিসরে কোনো আইডিয়া নিয়ে কাজ করা হতে পারে ব্যক্তির জন্য সবচেয়ে বড় প্রস্তুতি। কারণ, মাঠে না নামলে আসলে কখনো পুরোপুরি পরিবেশটা বোঝা যায় না।

ছোট পরিসরের প্রস্তুতি
ছোট পরিসরে প্রস্তুতি নিতে হলে খুব বেশি মূলধনের দরকার হয় না। যেমন:
* হস্তশিল্প নিয়ে কাজ করা
* ফ্রিল্যান্সিং
* পাইকার থেকে কিনে খুচরা ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করা
* অনলাইনে ব্যবসা (পোশাক, মেকআপ বা ঘর সাজানোর সরঞ্জাম ইত্যাদি)
এগুলো খুব সাধারণ ব্যবসার নমুনা, যা পড়াশোনার পাশাপাশি আজকাল অনেকেই করছেন। অবসর সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার হতে পারে এ রকম ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ততা। এ ধরনের ব্যবসা একই সঙ্গে মুনাফা আনছে। আবার গ্রাহকের সঙ্গে বোঝাপড়া থেকে শুরু করে দাম ঠিক করা, নেটওয়ার্কিং, ব্যবস্থাপনার মতো নানা ধরনের অভিজ্ঞতাও দিচ্ছে। বড় পরিসরে কাজ করতে চাইলে এই অভিজ্ঞতা খুব কাজে আসবে।
একজন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীর উচিত হবে নিজেকে এ ধরনের ব্যবসায়িক উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত রাখা; সেটি এককভাবে বা দলের মাধ্যমে—দুই রকমই হতে পারে। ভবিষ্যতে কারও সফল স্টার্টআপের ভিত্তিপ্রস্তর হতে পারে বর্তমানের ছোট ছোট উদ্যোগ। যিনি আজকের অবসরকে সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগাচ্ছেন, তিনি অবশ্যই কাজে না লাগানো অন্য একজনের চেয়ে আগামীকাল এগিয়ে যাবেন।

পড়ালেখার ফাঁকে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রস্তুতি
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সহশিক্ষা কার্যক্রম প্রস্তুতি গ্রহণের একটি ভালো মাধ্যম। বিভিন্ন সংগঠনে কাজ করার মাধ্যমে কাজ শেখা থেকে শুরু করে নেতৃত্ব গুণ অর্জন পর্যন্ত নানা কিছু শেখার আছে, যদি আসলেই কেউ শিখতে চান।
* কেস কম্পিটিশন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিভিন্ন ‘কেস কম্পিটিশন’ অনুষ্ঠিত হয়। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের একটি পরিস্থিতি দিয়ে দেওয়া হয়, সে অনুযায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে হয়। এই সমাধান খোঁজার দক্ষতা অনেকেরই থাকে না। পুঁথিগত বিদ্যায় পারদর্শী হলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কেস পড়েও অনেকেই বুঝতে পারেন না। এ ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলে নিজের অভিজ্ঞতা বাড়ে; পাশাপাশি ‘কেস সলভিং’ শেখা যায়, যা দক্ষতার ঝুলিতে নতুন কিছু যোগ করে।
* আইডিয়া সেশন এটি একজন উদ্যোক্তার জন্য দারুণ সুযোগ হতে পারে। নিজের ভাবনা অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া কিংবা অন্যের ভাবনা শোনা, বাস্তবতার মাপকাঠিতে পরিমাপ করা; সর্বোপরি চিন্তাভাবনার চর্চা করা—এর মাধ্যমে সৃজনশীল চিন্তাশক্তির জায়গাটাকে সচল রাখা যায়।
* আইডিয়া কম্পিটিশন আইডিয়া লুকিয়ে রাখার বিষয় নয়। নিজের আইডিয়া এই ২১ শতকের বাস্তবতায় পুরো বিশ্বে না, বরং নিজের একাডেমিক পরিবেশেই কতটুকু প্রতিযোগিতার যোগ্য, সেটা যাচাই করতে হলে বিভিন্ন আইডিয়া প্রতিযোগিতায় যাওয়া প্রয়োজন। এ ধরনের প্রতিযোগিতায় নিজের আইডিয়া যেমন বলার সুযোগ হয়, তেমনি অন্য সৃজনশীল মানুষের সঙ্গেও পরিচয় হয়।
* মেলায় অংশগ্রহণ কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় মেলার আয়োজন করেন। সাধারণত ব্যবসায় শাখার ছাত্রছাত্রীরা এ ধরনের অনুষ্ঠান করে থাকেন। সেখানে স্টল দিয়েও ছোট আকারে অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। এমন বিজ্ঞান মেলাগুলোতেও নিজের প্রকল্প নিয়ে অংশগ্রহণ করা উচিত, তাহলে ভাবনাটা অন্যের সামনে উপস্থাপনের একটা সুযোগ হয়।
* বিতর্ক মানুষকে বোঝানো কিংবা সুন্দর বাক্শৈলী অসাধারণ একটি গুণ। একজন উদ্যোক্তাকে বিভিন্ন অংশীদারের সঙ্গে কাজ করতে হয়। নিজের ধারণাকে যদি সুচারুভাবে প্রকাশের ক্ষমতা থাকে, তাহলে সহজেই অনেককে আকর্ষণ করা যায়। কথা বলার ভীতি কিংবা জড়তা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিতর্কের দক্ষতাটা ঝালিয়ে নেওয়া ভালো।
* গবেষণা ব্যবসার সঙ্গে সর্বদাই গবেষণা যুক্ত। বাজার বিশ্লেষণ, দাম নির্ধারণের কৌশল কিংবা বিভিন্ন স্টার্টআপের সফলতা-ব্যর্থতার কারণ গবেষণা করেই বের করা হয়। একজন ভালো উদ্যোক্তা হতে চাইলে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ ধরনের ক্লাবের সঙ্গে কাজ করে নিজেকে দক্ষতা অর্জনে আরও এক ধাপ এগিয়ে রাখা যায়। সাধারণ কিছু উপায়ের কথা তুলে ধরা মানে অন্য অনেক উপায় গুরুত্বহীন, তা নয়। যেমন কেউ যদি ফটোগ্রাফির প্রতিষ্ঠান করতে চান, তাহলে তিনি আলোকচিত্রের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। যাঁরা তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে চান, তাঁরা প্রোগ্রামিং ক্লাব বা রোবটিকস ক্লাবে যোগ দিতে পারেন। নিজের ইচ্ছার জায়গাটা আগে খুঁজে বের করতে হবে। সে অনুযায়ী প্ল্যাটফর্ম বের করে সেখান থেকে নিজেকে আরও বেগবান করা যাবে। এটা একাডেমিক পরিবেশের বাইরেও হবে। সামাজিক জীবনে প্রতিনিয়ত আমরা বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হই। এটা নেটওয়ার্কিংয়ের একটা অংশ। পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সুসম্পর্ক ব্যবসার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। আর এই সম্পর্ক তৈরির সময় প্রতিদিন। নিজের অবসর সময়টুকু ছোট কোনো ব্যবসায়িক কাজে এখন থেকেই কাটানোর সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী। অভিজ্ঞতা আর দক্ষতার বিকল্প কোনো দিন হবে না। তাই চেষ্টাটা ছোট করেই হোক, কিন্তু শুরু হোক।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, ইনোভেশন, ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ সেন্টার এবং সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়