চারে চার চারজন

বাঁ েথকে এরিন জামান, প্রীতম সাহা, শাহরোজা নাহরিন ও শায়ান শাহরিয়ার। ছবি: সুমন ইউসুফ
বাঁ েথকে এরিন জামান, প্রীতম সাহা, শাহরোজা নাহরিন ও শায়ান শাহরিয়ার। ছবি: সুমন ইউসুফ
>বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের সব কটি কোর্সে (বিষয়ে) যদি জিপিএ (গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজ) ৪ হয়, শুধু তাহলেই একজন শিক্ষার্থী সিজিপিএ (কিউমিউলেটিভ গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজ) ৪ নিয়ে বেরোতে পারেন। কেবল একটা দিনের অবহেলায় এই চার ফসকে যাওয়া পৃথিবীর সহজ এবং স্বাভাবিক ঘটনার একটি। কিন্তু ‘কঠিনেরে ভালোবেসে’ সেটি হতে দেননি তাঁরা। লিখেছেন জিনাত শারমিন

বাবা, তুমি খুশি হয়েছ?
এরিন জামান
, সাবেক শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ পেয়ে স্নাতক শেষ করেছেন এরিন জামান। ২০১৬ সাল থেকে সেখানেই আছেন শিক্ষক হিসেবে।

আলাপের শুরুতেই বললেন, ‘আমার কিন্তু এসএসসিতে জিপিএ–৫ ছিল না।’

ছেলেবেলা কেটেছে যশোরে। এরিনের বাবা খুব চেষ্টা করেছিলেন যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ভর্তি করানোর জন্য। কিন্তু এসএসসিতে জিপিএ–৫ ছাড়া সেখানে ভর্তি হওয়া সম্ভব নয়। অগত্যা এরিন ভর্তি হন যশোর মহিলা কলেজে। কিন্তু এই কলেজ থেকে ঠিকই তিনি উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ–৫ পেয়েছেন। এরপর শামিল হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধে। কিন্তু আবার সেই বিধি বাম। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ইচ্ছা ছিল, কোথাও চান্স পাননি তিনি। অবশেষে তাঁর সুযোগ হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এবার তাঁর জেদ চেপে যায়। এরিন ঠিক করলেন, আবার ভর্তি পরীক্ষা দেবেন। মেডিকেলের জন্য চেষ্টা করবেন। কিন্তু বাবা বলেছিলেন, ‘এখানেই এমনভাবে পড়াশোনা করো, যেন তুমি শিক্ষক হতে পারো।’

স্বপ্নটা যিনি দেখিয়েছিলেন, তিনিই দেখে যেতে পারেননি তাঁর এই সাফল্য। এরিন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্রী, তখন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর বাবা মারা যান। তাই শিক্ষক হিসেবে কাজে যোগ দিয়েই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন এরিন, ‘আব্বু, তুিম কই? একবার বলো খুশি হয়েছ।’

‘আমার জন্য চারে চার ধরে রাখাটা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল।’ বলছিলেন এরিন। ‘একেক সময় আব্বুর শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছিল। অনেক কান্নাকাটি, টেনশনের মধ্যেও আমি পড়ালেখা চালিয়ে গেছি। প্রায় প্রত্যেকটি পরীক্ষাতেই মনে হতো, এবার আর পারব না।’

এরিন শেষে যে কথাটা বললেন, তাতে তাঁর মনের জোরটা বোঝা যায় স্পষ্ট। ‘ভারত থেকে ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন, আব্বুকে আর বাঁচানো যাবে না। কিন্তু আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। তখন আমি আরও জেদ নিয়ে পড়ালেখা করেছি। ঠিক করেছিলাম, বাবাকে না হোক, বাবার স্বপ্ন তো আমি বাঁচিয়ে রাখতে পারি।’

এসব চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়েই এরিন প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে স্বর্ণপদক নিয়েছেন। ফেসবুকে সেই ছবি দিয়ে উৎসর্গ করেছেন বাবাকে।

জিনিয়াস হওয়া জরুরি নয়
প্রীতম সাহা
, শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

ইংরেজি ‘জিনিয়াস’ শব্দটি যাদের জন্য প্রযোজ্য, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক করা প্রীতম সাহা তাঁদের মধ্যে একজন। বুয়েটেই স্নাতকোত্তর করছেন তিনি। সঙ্গে খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা করছেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে। সপ্তাহের রবি ও সোমবার দুপুরে যিনি শিক্ষক, সেই প্রীতমকে সন্ধ্যাবেলায় দেখা যায় ছাত্রের ভূমিকায়। হাত নেড়ে, উচ্চ স্বরে, স্পষ্ট গলায় কথা বলেন তিনি। শিক্ষকতা পেশাটা যে উপভোগ করেন, বোঝা গেল।

চায়ে চুমুক দিয়ে কথা এগোয় প্রীতমের সঙ্গে। উচ্চমাধ্যমিকের পর মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় হয়েছিলেন দ্বিতীয়। সিজিপিএ চারে চারই চাই, এ সিদ্ধান্ত কি প্রথম বর্ষেই নিয়ে ফেলেছিলেন? প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘প্রথম সেমিস্টারে আমাদের ডিপার্টমেন্টে ছয়জন চার পেলাম। তখনই মনে হলো, এটাকে ধরে রাখতে হবে। দ্বিতীয় সেমিস্টারে দেখা গেল, শুধু আমি একাই চার।’

বটে। যে ছেলে তৃতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত টানা প্রথম হয়েছেন, কলেজেও ছিলেন প্রথম সারিতে, তাঁর এমন ফলাফল অস্বাভাবিক নয়। তাহলে কি চারে চার পাওয়া তাঁর জন্য তুলনামূলক সহজ ছিল? ‘আশপাশের প্রায় সবাই আমার সমান বা আমার চেয়ে বেশি মেধাবী। এ কারণে কাজটা খুবই কঠিন ছিল। একবার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোর্সে ক্লাস টেস্টে শূন্য পেয়েছিলাম, আরেকবার গণিতের একটি ক্লাস টেস্টে শিশুতোষ গাধামি করে ৫ পেয়েছিলাম। ইনফরমেশন সিস্টেম ডিজাইনের কোর্সের টার্ম ফাইনালে ২৮০ নম্বরের মধ্যে প্রায় ৩৫ নম্বর আমি উত্তরই করতে পারিনি। তবে সব সময় যেটা চেষ্টা করেছি, আমি যতটুকু উত্তর করব, সেটুকুই যেন ঠিক হয়। শিক্ষক যেন নম্বর কাটার সুযোগ না পান।’ কথা শুনে মনে হলো, প্রকৌশলী প্রীতম পড়ালেখায় কৌশলী ছিলেন বলেই সব সময় ভালো ফল ধরে রাখতে পেরেছেন।

কখনো কখনো পরীক্ষা দিয়ে প্রীতমের মনে হয়েছে, এবার বোধ হয় আর জিপিএ ৪ পাওয়া হবে না। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারটা তাঁর জন্য খুব কঠিন ছিল। প্রীতম বলেন, ‘প্রতি টার্মে ১৪ সপ্তাহের ক্লাস চলাকালীন আমাদের অনেকগুলো ল্যাব ওয়ার্ক করতে হয়। বেশ কয়েকটি ল্যাব ওয়ার্কে আমি প্রায় কিছুই পারছিলাম না। খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। শেষে আমাদের বিভাগের তখনকার চেয়ারপারসন সোহেল স্যার আমাকে ডেকে একদিন আমার সঙ্গে কথা বললেন।’ প্রীতম মনে করেন, প্রথমবার ৪ পাওয়া সহজ, কিন্তু এরপর সেটাকে ধরে রাখা অনেক বেশি কঠিন। প্রতিটা টার্ম পরীক্ষার সময় নাকি প্রীতম এতটাই আতঙ্কে থাকতেন, তাঁর মাথার চুল পড়ার হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেত!

প্রীতম সাহা এরই মধ্যে গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ডের বর্ষসেরা ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডর নির্বাচিত হয়ে ঘুরে এসেছেন আয়ারল্যান্ড। উচ্চশিক্ষার জন্য ভবিষ্যতে ভিনদেশে যাওয়ার ইচ্ছে তাঁর আছে।

আপনার কাছে জীবনে ভালো কিছু করার মন্ত্র কী? প্রশ্ন করতেই দুটি সূত্র শিখিয়ে দিলেন। ধৈর্য আর কাজের প্রতি আত্মনিবেদন। যে ‘জিনিয়াস’ শব্দটি দিয়ে শুরু করেছিলাম, প্রীতম নিজেকে মোটেও সেই রকম মনে করেন না। এ শব্দটিতেই বিশ্বাস করেন না তিনি। বরং তাঁর বিশ্বাস, ধৈর্য আর কাজের প্রতি আত্মনিবেদন থাকলে যে কেউই সফল হতে পারে। ‘জিনিয়াস’ হওয়াটা জরুরি নয়।

পড়ায় ভালো, লেখায়ও ভালো
শাহরোজা নাহরিন
, শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি

শাহরোজা নাহরিনের ঘরে ঢুকতেই ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেলাম। ঘর না বলে বরং লাইব্রেরি বলা ভালো, যে লাইব্রেরিতে এক কোণে শোয়ার ব্যবস্থাও আছে! শাহরোজা জানালেন, তাঁদের পুরো পরিবার লেখালেখির সঙ্গে জড়িত। বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র তিন গোয়েন্দার লেখক ও অনুবাদক রকিব হাসান সম্পর্কে তাঁর ফুফা হন। বাবা রহস্য পত্রিকার নিয়মিত লেখক। শাহরোজা নিজেও লেখালেখি করেন। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক করেছেন তিনি। পেয়েছেন সিজিপিএ–৪। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবেন কি না, তা নিয়ে একসময় সংশয় ছিল তাঁর মনে। সেই তিনি সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগে সবচেয়ে ভালো ফল করে স্বর্ণপদকের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। কীভাবে?

বুয়েটে স্থাপত্য নিয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিল শাহরোজার। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার আগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। পরে এক বন্ধুর পরামর্শে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন, চান্সও পেলেন। কিন্তু বাবা সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে এত খরচ বহন করা সম্ভব নয়। অগত্যা নিজের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছিলেন শাহরোজা নাহরিন। ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হওয়ার আগেই চাকরি নেন পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সে। পারিশ্রমিক মোটামুটি মন্দ ছিল না।

প্রথম দিন থেকেই কি প্রথম হওয়ার ইচ্ছা ছিল? এক মুহূর্তও না ভেবে বলেন, ‘হ্যাঁ, একেবারে প্রথম দিন থেকে আমি চেয়েছি ভ্যালেডিক্টোরিয়ান (কোনো বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা শিক্ষার্থী) হতে। প্রতিটি দিন ভ্যালেডিক্টোরিয়ানের সমাবর্তন ভাষণ নিয়ে আমি ভেবেছি। মনে মনে বলেছি, ওই মুহূর্তটা আমার চাই। তা ছাড়া আমার যেহেতু অর্থনৈতিক সংকট ছিল, তাই স্কলারশিপ পাওয়ার জন্যও আপ্রাণ চেষ্টা করেছি।’ তাঁর এই চেষ্টা সফল হয়েছিল। সপ্তম সেমিস্টার থেকে শুরু করে শাহরোজাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির জন্য আর একটি টাকাও দিতে হয়নি।

একে তো চাকরি, তার ওপর ইংরেজি সাহিত্যের মতো কঠিন একটি বিষয়ে এত ভালো রেজাল্ট, কী করে সামলেছেন? জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে বহুবার তিনি অসুস্থ হয়েছেন, নাটক করতে গিয়ে পা মচকেছে, তবু কোনো দিন ক্লাস মিস করেননি। ‘মন দিয়ে ক্লাস করলে ক্লাসেই ৭০ শতাংশ পড়া হয়ে যায়,’ বলছিলেন শাহরোজা। সবার যেখানে স্নাতক করতে চার বছর সময় লাগে, শাহরোজার লেগেছে সাড়ে তিন বছর। তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য কয়েকটি সেমিস্টারে পাঁচটি করে কোর্স নিয়েছিলেন তিনি।

কাজের চাপের মধ্যে পড়তেন কখন? প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে শাহরোজা ধন্যবাদ দিলেন ঢাকার যানজটকে। তাঁর ভাষায়, ‘দিনের অনেকটা সময় চলে যেত তুরাগ বাসে। এই বাসই আমার তখনকার সময়ের সবচেয়ে ভালো পড়ার জায়গা। বাসে বসে আমি যে কত বই পড়ে শেষ করেছি!’

শাহরোজা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগে কাজ করেছেন, কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের (চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষাকেন্দ্র) দুজন চীনা শিক্ষককে ইংরেজি শিখিয়েছেন এবং কয়েকটি বইয়ের অলংকরণের কাজও করেছেন। সঙ্গে পাঞ্জেরীর চাকরিটা তো ছিলই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চান তিনি। সেই সঙ্গে লেখক হওয়ার স্বপ্নটা তো আছেই। ‘দানব প্রহরী’ নামে পাঞ্জেরী থেকে এডাম ব্লেডের জনপ্রিয় সিরিজ ‘বিস্ট কোয়েস্ট’–এর অনুবাদ করছেন, ইতিমধ্যে এই সিরিজের প্রথম দুটি বই প্রকাশিতও হয়েছে। এ ছাড়া মার্চেই তাঁর রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম বের হবে।

৬ মার্চ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন। ভ্যালিডেক্টোরিয়ান হওয়ার স্বপ্ন পূরণ না হলেও, মায়ের কাছে তিনি পৃথিবীর সেরা সন্তান। এই অর্জনই বা কম কিসে!

কোনো বাধাই যাঁকে দমাতে পারেনি
শায়ান শাহরিয়ার, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শায়ান শাহরিয়ারের মা চেয়েছিলেন একমাত্র সন্তান ডাক্তার হোক, বাবা চেয়েছিলেন ছেলে যেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ২০১৪ সালের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও মেডিকেল—সব কটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুযোগ পাওয়া পরীক্ষার্থীদের নামের তালিকায় শায়ানের রোল প্রথম দিকে। শেষ পর্যন্ত তিনি ভর্তি হন এমন একটি বিষয়ে, যাতে চিকিৎসা ও প্রকৌশল—দুটি বিদ্যারই সংমিশ্রণ ঘটে। আর তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি (জিইবি)। কদিন আগেই প্রকাশিত ফলে জানা গেছে, স্নাতকে তাঁর সিজিপিএ–৪।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু থেকেই মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু প্রথম মায়াস্থেনিয়া গ্রাভিস নামে একটি জটিল ও বিরল রোগে আক্রান্ত হন তিনি। সিঙ্গাপুর গিয়ে অপারেশন করিয়েছেন। অপারেশনের পর, ঘা শুকানোর আগেই ১৭ দিনের মাথায় ক্লাসে পা রেখেছেন তিনি।

এখন কেমন আছেন? জানালেন, আগের চেয়ে অনেকটাই ভালো। তবে এখনো ‘ডবল ভিশন’ (দুটি প্রতিবিম্ব) দেখতে পান। অসুখের কারণে অল্পতেই ক্লান্ত বোধ করার কথা, কিন্তু শায়ানের নাকি ক্লান্ত লাগে না! শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে বলে প্রতিদিন ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই প্রভাব ফেলতে পারেনি তাঁর সিজিপিএতে। ঠিকই চারে চার ধরে রেখেছেন তিনি।

শুরু থেকেই কি শতভাগ ভালো রেজাল্ট করার সংকল্প ছিল? শায়ান বলেন, ‘ভালো করার ইচ্ছা আমার শুরু থেকেই ছিল। আমি জানতাম, এই ডিপার্টমেন্টে অনেকেই ভালো রেজাল্ট করে। ৩.৯ অহরহই ওঠে। কিন্তু শুরু থেকে কখনোই ৪–এর টার্গেট নিয়ে পড়াশোনা করিনি। দ্বিতীয় বর্ষটা খুব কঠিন ছিল। অসুস্থতা, ক্লাস মিস দেওয়া মিলিয়ে মিডটার্মগুলো ভালো হয়নি। এ প্লাস পেতে হলে বেশ কয়েকটি বিষয়ে ফাইনালে প্রায় ৯০ শতাংশ নম্বর লাগত। আমি প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তবু কীভাবে যেন ঠিকই এ প্লাস পেয়ে যাই। এতই অবিশ্বাস্য ছিল যে মা কেঁদে ফেলেছিলেন।’ ৪-এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্য শায়ান সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছেন চতুর্থ বর্ষে। ৪-এ ৪ তিনি কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চাননি।

শায়ান দুই বছর বায়োলজি অলিম্পিয়াডের একাডেমিক কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োজিত আছেন। গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক দলের সঙ্গেও কাজ করছেন তিনি। জিইবি বিভাগ থেকে প্রকাশিত বায়োজেন ম্যাগাজিনের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি নিজের শহর বরিশালে অ্যাডো সায়েন্স ক্লাবের প্রেসিডেন্টে।

মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারত ছাড়াও বাংলাদেশের চল্লিশটি জেলা ঘুরে দেখেছেন শায়ান। ছবি তুলতে ভীষণ ভালোবাসেন। থাইল্যান্ডের ওয়ালাইলাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কালচারাল ক্যাম্পের জন্য নির্বাচিত হয়ে ৩৩টি দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ১০ দিনের ক্যাম্পে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খাবার চেখে দেখা শায়ানের শখ।

স্নাতক শেষে চলছে স্নাতকোত্তরের পাঠ। এরপর? জানা গেল, যুক্তরাজ্য থেকে ‘মাস্টার্স ইন রিসার্চ’ ডিগ্রি নেওয়া পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলো ঘুরে ছবি তোলার স্বপ্ন তাঁর। ঘোরাঘুরি শেষে দেশে ফিরে শিক্ষকতা ও গবেষণা করতে চান। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞানকে উপভোগ্য করার জন্য ‘কিছু একটা’ করার তীব্র ইচ্ছা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি।