স্বপ্নময় সঞ্জয়

সঞ্জয় চৌধুরী। ছবি: মঈনুল ইসলাম
সঞ্জয় চৌধুরী। ছবি: মঈনুল ইসলাম

কখনো সঞ্জয়। আবার কখনো সঞ্জয় দাদা। ক্যাম্পাসে পথ চলতে এভাবেই শুনতে হয় ডাক। পড়ার ফাঁকে প্রতিদিনই সামাজিক কর্মকাণ্ডে ছুটে চলেন। ক্যাম্পাসজুড়ে শিক্ষার্থীদের প্রিয় মুখ, শিক্ষকদেরও। রবীন্দ্র, নজরুল, শাস্ত্রীয়, আধুনিক—সব গানই শেখা আছে। তবে রবীন্দ্র ও নজরুলসংগীত গাইতে ও শুনতে তাঁর ভালো লাগে। বিতর্কেও পিছিয়ে নেই। সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে ছুটে চলেন অবিরাম। পুরো নাম সঞ্জয় চৌধুরী। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগে চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন।
সাত বছর বয়সে যখন প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী, তখন থেকেই মায়ের হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছুটে যেতেন। শিল্পীদের গান শুনতেন মা। আর ভাবতেন ছেলে যদি এভাবে একদিন মঞ্চে গান গাইত! মা হারমোনিয়ামে গান গাইতেন। বাবা বাজাতেন তবলা। শিশুকালে মায়ের হাত ধরেই সঞ্জয়ের হারমোনিয়ামের রিডে হাত। সুরের তালে রিড টেপাটেপি। সা রে গা মা পা ধা নি...। মা বলতেন, ‘বাহ, ভারি সুন্দর। তোকে দিয়েই হবে স্বপ্ন পূরণ।’ শিশু বয়সেই গানের তালিম নেওয়ার পর মায়ের স্বপ্ন এখন পূরণ হওয়ার পথে।
আনুষ্ঠানিকভাবে সংগীত শিক্ষায় গানের প্রথম তালিম নিয়েছেন সুব্রত ভট্টাচার্যের কাছে। সুব্রত স্যার কুড়িগ্রামে সবার প্রিয় ব্যক্তিত্ব। সুব্রত স্যারকে গানের শিক্ষাগুরু হিসেবে ভাবেন সঞ্জয়।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে কুড়িগ্রামে। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ভবানন্দের কুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পর একই উপজেলার কালীগঞ্জ হুজুর আলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং নাগেশ্বরী ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবা গণেশ চৌধুরী। পেশায় কৃষক। আর মা রিনা চৌধুরী গৃহিণী। দুই ভাইয়ের মধ্যে সঞ্জয় ছোট।
২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই বছর থেকেই ক্যাম্পাসভিত্তিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক ‘রণন’-এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদের সান্নিধ্যে এসে ক্যাম্পাস সবুজায়ন করার লক্ষ্যে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে ঝুঁকে পড়েন। এই কাজের সফলতা আসায় গত তিন বছর থেকে এই সংগঠনের (রণন) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন সঞ্জয়।
সংগীতচর্চা, ক্যাম্পাস সবুজায়ন কর্মসূচি বাইরে প্রথম বর্ষ থেকেই ক্যাম্পাসে রিভারাইন পিপল সংগঠনের সদস্য হয়ে যান। ক্যাম্পাসে নদীচিত্র প্রদর্শনী আয়োজনের সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করে সুনাম অর্জন করেন। এ ছাড়া গত দুই বছর (২০১৮-১৯) রণন ও গুনগুন সংগঠনের আয়োজনে যে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়, সেই মেলার সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। বইমেলাকে সফল করে তুলতে সঞ্জয়ের ছিল অক্লান্ত পরিশ্রম।
শুধু কি তাই? ক্যাম্পাসে শত কণ্ঠে হাজার কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিচালনায় প্রধান সংগীতশিল্পীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৭ সালের মার্চে কবি নির্মলেন্দু গুণের লেখা ও সঞ্জয়ের সুরে এবং কণ্ঠে পতাকার গান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ পায়। সাবেক উপাচার্য এ কে এম ন-র-উন নবী উদ্বোধন করেন।
সঞ্জয় চৌধুরীর নিজের লেখা, সুর ও কণ্ঠে নদীর জন্য গান ‘রক্তশূন্য দেশ’ শিরোনামে ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট নদী অধিকার দিবসে তিস্তা নদীর পাড়ে প্রকাশ পায়। ওই একই বছর জাতীয় নদী অলিম্পিয়াডে গানটি থিম সং হিসেবে গৃহীত হয়।
২০১৭ সালে ক্যাম্পাসে নারী ও শিশুবিষয়ক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় তাঁর নিজের ক্যামেরায় তোলা একটি ছবি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে।
এত কিছু কর্মকাণ্ডের পরও তিনি বিতর্কচর্চায় পিছিয়ে নেই। বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেট ফোরামের দুই বছর সাধারণ সম্পাদক ও জিওগ্রাফার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে বিজয়ী হয়ে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কোনো কিছুতে মন না বসলে গান লিখতে বসে যাওয়া যেন তাঁর অভ্যাস। ভালো লাগে বলেই গান লেখেন বলে জানালেন সঞ্জয়। সংগীত বিতর্কের পাশাপাশি আরও ভাবলেন কী করা যায়। পরিবেশ নিয়ে সবুজের প্রতিধ্বনি সংগঠনের মাধ্যমে ক্যাম্পাসের বাইরেও ছুটে চলেন অবিরাম। ক্যাম্পাস সবুজায়নের ক্ষেত্রে গাছের খুঁটি দেওয়া, গর্ত করে রোপণ করা, গাছ থেকে পেরেক উত্তোলন, গাছে পানি দেওয়া, সার প্রয়োগে পিছিয়ে নেই সঞ্জয়। বিভিন্ন দিবসে সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঞ্জয় ছুটে চলেন। হয়ে ওঠে সবার অতি প্রিয়।
ভূগোল বিদ্যায় পড়াশোনা করলেও ভবিষ্যতে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা অব্যাহত থাকবে বলে দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন সঞ্জয়। সেই সঙ্গে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। আর যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই এত দূরের পথ চলা, সেই পথের দিশারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গানের শিক্ষাগুরু সুব্রত স্যার ও বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল যেন করতে পারেন—এমন আশার কথাও শোনা যায় সঞ্জয়ের মুখ থেকে। সঞ্জয় আরও বললেন, দেশকে ভালোবাসতে হবে। ভালো কাজ করে দেশকে আলোকিত করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে জাগিয়ে তুলতে হবে। যেতে হবে দূরে, বহুদূরে...।