কেমন ডাক্তার তৈরি হচ্ছে?

ডাক্তার
ডাক্তার
>

* বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষক-সংকট প্রকট
* বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর অভাবে শিক্ষার্থীদের হাতে–কলমে শেখার সুযোগ কম।

সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শেষ হওয়ার পর মেধাতালিকার নিচে থাকা শিক্ষার্থীরাই বেসরকারি কলেজে যান। বেশির ভাগ সময় সেখানে মানসম্পন্ন হাসপাতাল বা পর্যাপ্ত রোগী থাকে না। হাতে-কলমে শেখার সুযোগ খুব কম থাকে। ভরসা শুধু বইয়ে পড়া বিদ্যা।

পাঁচ বছর পড়ার পর এমবিবিএস পরীক্ষায় বসে বেসরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা তাই পাস করেন কম। পাস করা চিকিৎসকেরা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে গেলে সেখানেও হোঁচট খান বেশি। সাম্প্রতিক ১০ বছরের ফলাফল তেমনটাই বলছে। আবার, নিয়োগের বেলায় প্রতিষ্ঠিত বড় হাসপাতালগুলো সরকারি কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসকদেরই খোঁজে।

একাধিক প্রবীণ শিক্ষক ও চিকিৎসকের মতে, শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণ—এসব সুযোগ-সুবিধা সরকারি কলেজগুলোতে বেশি। ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাতে-কলমে শিক্ষার যে সুযোগ আছে, বেসরকারি কোনো কলেজে তা নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধ্যাপক আবদুল জলিল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে, হাসপাতালের ব্যবস্থা না করে যত্রতত্র কলেজ স্থাপন করলে অর্ধশিক্ষিত চিকিৎসক তৈরি হবে। তাতে আর যা-ই হোক, মানুষ মানসম্পন্ন চিকিৎসা পাবে না।’ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সরকারও এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বেসরকারি কলেজগুলো যেন ঠিকমতো চলতে পারে, তার উদ্যোগ আমরা নেব।’

হাসপাতালে রোগীর আকাল
শরীয়তপুর জেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার পুবে মধুপুর গ্রামে গড়ে উঠেছে মনোয়ারা সিকদার মেডিকেল কলেজ। নড়িয়া-ভেদরগঞ্জ সড়কের পাশে কলেজের ক্যাম্পাস। এর উদ্যোক্তা দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। সিকদারের পৈতৃক বাড়ি-সংলগ্ন ৫ একর ১০ শতক জমিতে তাঁরই স্ত্রীর নামে হয়েছে এই কলেজ ও হাসপাতাল। ৭ মার্চ গিয়ে এখানে শয্যায় ভর্তি কোনো রোগী পাওয়া যায়নি। বহির্বিভাগে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে পাঁচজন রোগীকে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়।

কলেজটি ২০১৫ সালে অনুমোদন পায়। ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন আছে। তবে এখানে ভর্তির সংখ্যা ওঠানামা করে। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন ৪০ জন, পরের বছর ৬ জন আর তারপরের বছর আবার ৪৫ জন। এবার ৭ জন ভর্তি হয়েছেন।

মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার দেড় বছরের মাথায় ব্যবহারিক পাঠ হিসেবে শিক্ষার্থীদের রোগী দেখতে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মনোয়ারা সিকদার কলেজের চতুর্থ বর্ষের একজন শিক্ষার্থী বলেছেন, চতুর্থ বর্ষ শেষ হতে চলেছে। কিন্তু তাঁরা হাসপাতালে রোগীর দেখা পাচ্ছেন না।

শিক্ষার্থীটির ভয়, রোগী নাড়াচাড়া না করেই শিক্ষা শেষ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পুষ্পেন রায় অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, এই শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে হাসপাতাল ভালো অবস্থায় পৌঁছাবে।

চিকিৎসা শিক্ষায় হাতে-কলমে জ্ঞান অর্জন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বারবার বহু রোগীর সঙ্গে কথা বলে, রোগীর শরীর স্পর্শ করে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা দেওয়া শিখতে হয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. ইসমাইল খানের মতে, চিকিৎসা শিক্ষার ৮০ ভাগই হচ্ছে ব্যবহারিক শিক্ষা। বাকিটা পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ব্যবহারিক শিক্ষার জন্য দরকার রোগী। আর রোগীর জন্য দরকার হাসপাতাল। উপযুক্ত হাসপাতাল ছাড়া মেডিকেল শিক্ষা হয় না।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালায় বলা আছে, ৫০ আসনের কলেজের জন্য একই ক্যাম্পাসে ২৫০ শয্যার আধুনিক হাসপাতাল থাকতে হবে। হাসপাতালের ৭০ শতাংশ শয্যায় নিয়মিত রোগী থাকতে হবে। ১৩টি বেসরকারি কলেজের সাম্প্রতিক সরকারি পরিদর্শন প্রতিবেদন প্রথম আলোর কাছে আছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর একটিও এই শর্ত পূরণ করতে পারেনি।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ব্রায়েন বঙ্কিম হালদার সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা শিক্ষা সম্পর্কে ২০১৩-১৪ সালে একটি গবেষণা করেছিলেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বেসরকারি মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা চিকিৎসার ব্যবহারিক দক্ষতা বা জ্ঞান পাচ্ছেন না। শুধু বই পড়ে তাঁরা তাত্ত্বিক ডাক্তার হচ্ছেন।’

শিক্ষক নেই
চট্টগ্রাম শহরের নাছিরাবাদ এলাকায় ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ। শুরুতে ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন ছিল। সেটা বেড়ে এখন ৬৫ জন হয়েছে। ৬ মার্চ এই কলেজে গিয়ে জানা যায়, শিক্ষক আছেন ৫০ জনের কম। শারীরবিদ্যা বা ফিজিওলজি বিভাগে কোনো শিক্ষকই নেই।

চিকিৎসা শিক্ষার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ঠিক করেছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। বিএমডিসি বলছে, ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা কলেজে কমপক্ষে ১৭৭ জন শিক্ষক দরকার। ছাত্রভর্তি বাড়লে শিক্ষকও আনুপাতিক হারে বাড়বে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রথম আলোকে ৬৯টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষকের তথ্য দিয়েছে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, এ হিসাব কলেজ কর্তৃপক্ষের। হিসাবগুলো ঠিক কি না, তা তাঁরা মিলিয়ে দেখেননি।

ওই হিসাব বলছে, বিক্রমপুর ভূঁইয়া মেডিকেল কলেজে ৪২ জন শিক্ষক আছেন। কলেজটিতে ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন আছে। বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। দেশের সবচেয়ে পুরোনো এবং নামকরা এই বেসরকারি চিকিৎসাবিদ্যা প্রতিষ্ঠানকে ১৭ ফেব্রুয়ারি চিঠি দিয়ে দ্রুত বিভিন্ন বিষয়ে ৫১ জন শিক্ষক নিয়োগ দিতে বলেছে বিশ্ববিদ্যালয়।

মেধা ও পাসের হার
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা-শিক্ষাসংক্রান্ত বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুজন কর্মকর্তা বলেছেন, সরকারি ও বেসরকারি কলেজে প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে নেওয়া হয়। প্রতিবছর সরকারি কলেজে ভর্তি শেষে বেসরকারি কলেজগুলোতে ভর্তি শুরু হয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলের ওপর আবেদনের যোগ্যতা এবং লিখিত পরীক্ষায় পাস নম্বর স্থির করে। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে এই নম্বর ধরা হয়েছে ৪০। কর্মকর্তারা বলেছেন, ৬১-এর ওপরে নম্বর পাওয়া ছেলেমেয়েরা সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি হন। এর কম নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীরা গেছেন বেসরকারি কলেজে।

সরকারি মেডিকেল কলেজের চেয়ে এখন বেসরকারি মেডিকেল কলেজে আসন বেশি। এমবিবিএস পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও বেসরকারি কলেজে বেশি। কিন্তু পাসের হার বেশি সরকারি কলেজগুলোতে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের অধীনে সরকারি কলেজের সঙ্গে কেন্দ্রীয়ভাবে এমবিবিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

ফলাফলের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে নিয়ে ১০ বছরে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে যত ছাত্র ভর্তি হয়েছে, পাস করাদের হার তার প্রায় অর্ধেক। সরকারি মেডিকেল কলেজে পাস করা শিক্ষার্থীরা মোট ভর্তির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ। এ হিসাব অবশ্য মোট ভর্তি ও পাস করা শিক্ষার্থীদের সংখ্যার নিরিখে। তবে এতে পাসের ধারা বোঝা যায়।

পাস করা চিকিৎসকেরা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) নিবন্ধিত হয়ে পেশায় ঢোকেন। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসকদের মানের পার্থক্য ধরা পড়ে স্নাতকোত্তর (এফসিপিএস) পর্যায়ে এসে।

বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিসিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস) স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেয়। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, এ বছর এফসিপিএস প্রথম পর্বের পরীক্ষায় মাত্র ৮ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেন। তাঁদের এক-চতুর্থাংশ ছিলেন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী।

আস্থা কম
দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালগুলো মেডিকেল কর্মকর্তা (এমও), আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমএ) ও রেজিস্ট্রার নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসক বেছে নিচ্ছে।

অ্যাপোলো হাসপাতালের একজন ব্যবস্থাপক প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁর হাসপাতাল এই পদগুলোতে সরকারি কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসকদেরই নিচ্ছে।

ইউনাইটেড হাসপাতালের যোগাযোগ ও ব্যবসায় উন্নয়ন বিভাগের প্রধান সাগুফা আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁদের ৯০-৯৫ শতাংশ চিকিৎসক সরকারি কলেজ থেকে পাস করা। তিনি বলেন, তাঁর হাসপাতাল বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসকদের ওপর পুরোপুরি আস্থা পায় না। তাঁরা কোনো ঝুঁকি নিতে চান না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদের মতে, সরকারের উচিত সব বেসরকারি মেডিকেল কলেজকে দু-তিন বছর সময় দিয়ে মান উন্নয়ন করতে বলা। নিজের শিক্ষক তৈরি করে নিতে কলেজগুলোর উদ্যোগী হতে হবে। সরকার প্রয়োজনে তাদের সহায়তা করতে পারে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন শরীয়তপুর প্রতিনিধি সত্যজিৎ ঘোষ ও চট্টগ্রাম প্রতিনিধি প্রণব বল]