৮ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছভর্তি, অন্যরা চুপ

শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে উচ্চশিক্ষায় (স্নাতক সম্মান) ভর্তির সময় এলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিতভাবে বা গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা চালু নিয়ে তোড়জোড় হয়। এক দশকের বেশি সময় ধরে এই আলোচনায় এক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে। আসন্ন শিক্ষাবর্ষ (২০১৯-২০) থেকে কৃষি ও কৃষির প্রাধান্য থাকা আট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একই দিনে ও একই প্রশ্নপত্রে সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিতে সম্মত হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের অনেকেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালুর পক্ষে অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, মেডিকেল কলেজগুলোতে একসঙ্গে ভর্তি পরীক্ষা হয়। একাদশ শ্রেণিতে কলেজে ভর্তি হয় মেধার ভিত্তিতে। তাই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা না হওয়ার যুক্তি খুঁজে পান না তাঁরা।

তবে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের বড় অংশের আর্থিক সংশ্লেষ থাকে এবং এই টাকা সম্মানী বা দায়িত্ব ভাতা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তি থেকে সর্বনিম্ন কর্মী পেয়ে থাকেন। সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট-বড় ভেদে প্রতিবছর ভর্তি বাবদ আয় ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত। এই টাকার বড় অংশই মূলত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভাগাভাগি হয় নানা খাতে।

শিক্ষাবিদেরা বলছেন, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের ছোটাছুটি বা হয়রানি কমবে, অভিভাবকদের আর্থিক চাপও কমবে। কিন্তু ভর্তি ফি বাবদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় কমে যাবে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা না হওয়ার এটিই বড় কারণ।

সাবেক শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান ভর্তি পদ্ধতিতে শিক্ষকদের বড় অংশের আর্থিক সংশ্লেষ আছে। ফলে তাঁরা এই পদ্ধতিতেই বেশি আগ্রহী। কিন্তু শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের দুর্ভোগ কমাতে অবশ্যই সমন্বিত বা গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা হওয়া উচিত। তবে এই গুচ্ছ হওয়া উচিত বিষয়ভিত্তিক। এসএসসি ও এইচএসসির ফলের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সাবেক এই সচিব বলেন, এখন সাধারণত ১০০ নম্বরের ভর্তি পরীক্ষা হয়। সেটাও যে একেবারে নির্ভুল নয়, তা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকেও জানা যাচ্ছে।

এখন এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা চলছে। এই পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর শুরু হবে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির যুদ্ধ। এক দশক ধরে আলোচনার ধারাবাহিকতায় এ বছর থেকে কৃষিবিষয়ক আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হবে। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় এবং সমধারার পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালুর কাজটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পক্ষ থেকে দেখভাল করছেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মো. আখতার হোসেন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এই ভর্তি প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দেবে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পরের বছরগুলোতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃত্বে থাকবে। ভর্তি ইচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী কোন কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা দেবে, তাও তাদের পছন্দের ভিত্তিতে ঠিক করা হবে।

বর্তমানে দেশে স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৪৯ টি। এর মধ্যে ৪৫ টিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা হয়। এখন শিক্ষার্থী ও প্রতিযোগিতা দুটোই বেড়েছে। একজন শিক্ষার্থী ১০ থেকে ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন। ভর্তির সময় এলেই দেখা যায় একেকজন অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের নিয়ে ছুটছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এতে ছাত্রীরাই বেশি সমস্যায় পড়েন।

এই ভোগান্তি কমাতে ২০০৮ সাল থেকেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় চেষ্টা করে এলেও সফল হয়নি। অভিযোগ আছে, আবেদন ফরম, খাতা ও পরিদর্শন ফি বাবদ যত টাকা খরচ হয়, তার কয়েক গুণ বেশি টাকা ভর্তি-ইচ্ছুকদের কাছ থেকে আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী, ভর্তি পরীক্ষার আয়ের ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা রেখে তা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করার কথা। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এই নিয়ম মেনে তা করে না বলে অভিযোগ আছে। স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখার কথা বলে সমন্বিত ভর্তিতে রাজি হয় না। যেহেতু আলাদা আইনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে, তাই সরকার জোর করে সিদ্ধান্ত চাপিয়েও দিতে পারে না।

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কথা বিবেচনা করে গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ উপাচার্যদের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালুর পরামর্শ দেন। এরপর এই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার তৎপরতা ইতিবাচক পথে এগোতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে মিলিত হয় ইউজিসি। সেখানেই আটটি বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিতে রাজি হয়।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, সব বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু এখনো রাজি হয়নি, তাই তাঁরা আটটি বিশ্ববিদ্যালয় আসন্ন শিক্ষাবর্ষ থেকেই গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

সরকারের লক্ষ্য হলো, পর্যায়ক্রমে একই ধারার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একেকটি গুচ্ছে এনে একটি ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো। যেমন এরপর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একেকটি গুচ্ছ করে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে।

জানতে চাইলে ইউজিসির সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবে সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়েই সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা হওয়া উচিত। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পর ধাপে ধাপে প্রযুক্তিসহ অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয় এই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেবে বলে তিনি আশা করেন।

এদিকে ৬ মে এক পত্রে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক পর্যায়ে কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া ও ভর্তি পদ্ধতির নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে ইউজিসিকে তাগিদ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

জানতে চাইলে বিদেশে অবস্থানরত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব সোহরাব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ইউজিসির সুপারিশ পেলেই মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

তবে ইউজিসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যুক্তি হলো, আলাদা আলাদা গুচ্ছ করলে শিক্ষার্থীদের কয়েকটি পরীক্ষা দিতে হবে। তাঁর যুক্তি হলো, এমন পদ্ধতি বের করা উচিত যেখানে একটি ভর্তি পরীক্ষা দিয়েই যেন শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারে। তিনি বলেন, বর্তমানে এসএসসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করা গেলে উচ্চশিক্ষায় কেন এইচএসসির ফলকে আস্থায় নেওয়া যাবে না?

জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের অর্থের অপচয় ও দুর্ভোগ কমাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তির কোনো বিকল্প নেই। ভর্তি পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাড়তি আয়ের উপায় হয়ে উঠেছে। এ জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছভিত্তিক পদ্ধতি চায়নি। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে এটা করতেই হবে।