কৃষকের পাশে শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা

কৃষকের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে ধান কাটছেন শিক্ষার্থীরা
কৃষকের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে ধান কাটছেন শিক্ষার্থীরা

কিছুদিন আগে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে খবরটি। ধান কাটার শ্রমিকের পারিশ্রমিক বেশি, কিন্তু সেই তুলনায় ধানের দাম কম—এই ক্ষোভে টাঙ্গাইলের কৃষক আবদুল মালেক তাঁর নিজের ধানখেতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন। এই খবর ভাবিয়ে তুলেছিল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগের ছাত্র ফয়সাল আহমেদকে। কৃষকের প্রতি কীভাবে সহমর্মিতা প্রকাশ করা যায়, কীভাবে তাঁদের সাহায্য করা যায়, সচেতনতা তৈরি করা যায়, ভাবছিলেন তিনি। তাঁর ভাবনার ফসল—পত্রিকায় প্রকাশিত আরও একটি খবর: কৃষকের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে এক কৃষকের ধান কেটে দিয়েছেন শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা। কীভাবে নেওয়া হলো এই উদ্যোগ?

গত ১৪ মে। ইফতারের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী তপোবন আবাসিক এলাকায় একটি মেসে আলোচনায় বসেন শাবিপ্রবির চার শিক্ষার্থী—যন্ত্রকৌশল বিভাগের এনামুল হক ও মীর সাব্বির আহমেদ চৌধুরী, স্থাপত্য বিভাগের শুভ্র মাহমুদ এবং সিএসইর ফয়সাল আহমেদ। কৃষকের ধান চাষ ও বিক্রির সংকট নিয়ে আলোচনায় বসার স্থান—ক্রাইসিস-২ মেস! ক্রাইসিস-২ মেসের নামকরণের ইতিহাস প্রায় একই। এই মেসের বাসিন্দারা নানা সংকটে (ক্রাইসিস) থাকেন। আর সব ধরনের সংকট নিয়ে তাঁরা সোচ্চার হন, প্রতিবাদ করেন। ফয়সাল বলেন, ‘আমাদের মাথায় ছিল, কৃষকদের জন্য একটা কিছু করতে হবে।’

কয়েক ভাগে দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়। যন্ত্রকৌশলের শিক্ষার্থী আবরার সালেকিন ও মীর সাব্বিরকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পড়াশোনা করে বিষয়টির কারণ অনুসন্ধানের। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের কাছে খবর পৌঁছে দিয়ে ধান কাটার মানুষ জোগাড় করার দায়িত্ব দেওয়া হয় যন্ত্রকৌশলের শিক্ষার্থী এনামুল ও স্থাপত্যের সাদিয়া আফরিনকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ প্রচার-প্রচারণার দায়িত্ব পান যন্ত্রকৌশলের তিন শিক্ষার্থী—ঐশ্বর্য সরকার, রিফাত জাহান ও মাহফুজুর ইমতিয়াজ। আর দরিদ্র কৃষক (যাঁরা টাকার অভাবে ধান কাটতে পারছেন না) খোঁজা ও ধান কাটার কাস্তে সংগ্রহের দায়িত্ব নেন ফয়সাল ও শুভ্র। তাঁরা ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ২২ জন কৃষকের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের মধ্যে মনির মিয়া নামে দরিদ্র এক কৃষকের সন্ধান পান।

১৫ মে সারা দিন চলে কর্মযজ্ঞ। ইফতারের পর আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে কাজের অগ্রগতির খোঁজ নিয়ে তাঁরা নতুন পরিকল্পনায় বসেন। কারণ অনুসন্ধান দলের সদস্য সাব্বির বলেন, ‘আমরা জানতে পারলাম, কৃষকের বর্তমান সংকটের পেছনে আমদানি ও মজুতসহ পুরো সিস্টেমেই দুর্নীতি হয়েছে। ধান কাটার মাধ্যমে আমরা সাধারণ মানুষকে সেটাই জানাতে চেষ্টা করেছি।’

১৬ মে বেলা ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা রওনা হন ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী মনির মিয়ার ধানখেতের উদ্দেশে। ধানখেতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেছা চৌধুরী ছাত্রী হলের পশ্চিম দিকে। শিক্ষার্থীদের দেখে মনিরের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মনির তাঁর ভাই মতিন মিয়াকে সঙ্গে করে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে যান ধানখেতে। শুরু হয় ধান কাটা, চলে বেলা ২টা পর্যন্ত। ক্যাম্পাস বন্ধ। তবুও যাঁরা ক্যাম্পাসে ছিলেন, প্রায় সব শিক্ষার্থীই অংশ নেন ধান কাটায়।

গ্রীষ্মকালীন ও ঈদের ছুটির টানা এক মাস বন্ধের কারণে অনেকের বাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। তবে প্রতীকী প্রতিবাদে অংশ নিতে বাড়িতে যাননি কেউ কেউ। ঐশ্বর্য সরকারের ভাষায়, ‘১৪ তারিখের পর ক্যাম্পাস বন্ধ ছিল। শুধু এই প্রোগ্রামে অংশ নিতে বাড়ি যাইনি, সিলেটে থেকে গিয়েছি।’

সিএসই বিভাগের মিশকাত, আসিফ মেসবাহ্, যন্ত্রকৌশলের ফারহাত নোমান, আবরার সালেকিন, স্থাপত্যের ঐশ্বর্যসহ প্রায় সব শিক্ষার্থীই জীবনে কোনো দিন ধান কাটেননি। আবরার বলেন, ‘জীবনে প্রথম ধান কাটতে নেমেছি। অনেকে রোজা রেখে প্রখর রোদে ধান কেটেছে। শরীরের শক্তি কমে যাচ্ছিল বুঝেও শেষ পর্যন্ত আমরা চেষ্টা করেছি। কষ্ট হয়েছে। কিন্তু কৃষকের জন্য সহমর্মিতা ও প্রতীকী প্রতিবাদে অংশ নিয়েছি ভেবে ভালো লাগছে।’

অনেকে ইউটিউবে কাস্তে দিয়ে ধান কাটার ভিডিও টিউটোরিয়াল খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তাই কৃষক মতিন মিয়া তাঁদেরকে ধান কাটার কৌশল শিখিয়ে দেন। কাস্তে কম থাকায় পালা করে ধান কাটায় অংশ নিতে অনেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন বলে জানালেন সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী মিশকাত মুস্তাফিদ ও আতিক শাহরিয়ার। এনামুল হক বলেন, ‘আমরা এই মর্মে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম যে শেষে যদি ১০ জনও থাকি তবুও প্রতীকী প্রতিবাদ করবই। পরে অবশ্য ২০ থেকে ২২ জন সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করেছে, বিভিন্নভাবে অংশ নিয়েছে আরও ১০০ জনের বেশি।’

সংগঠক ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই না, সব স্তরের মানুষেরই কৃষকের পাশে দাঁড়ানো উচিত।’