এইচএসসির পর কী, কোথায়, কেন পড়বে?

এবারের এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে অনেকেই পরীক্ষা–পরবর্তী ঘুমেরও সুযোগ পায়নি। কয়েক দিন আগে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছি, যেখানে এ রকম কয়েক শ শিক্ষার্থী ছিল। ওরা প্রস্তুতি নিতে ঢাকায় এসে পড়েছে। ওরা ঈদে বাড়িও যাবে না হয়তো, কারণ এখন একটি কঠিন পরীক্ষার প্রস্তুতি। হিসাব করে দেখেছি, ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে কমপক্ষে তিন লাখ এইচএসসি পরীক্ষার্থী এখন ঢাকায় এসে পড়েছে। বিভিন্ন কোচিং সেন্টার ও বুয়েট-ঢাবির শিক্ষার্থীদের কাছে প্রস্তুতি সহায়তাই এসবের কারণ।

এইচএসসির পর কী পড়বে, কোথায় পড়বে—এই সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব একটা সহজ নয় বর্তমানে। দেশে ১৫১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫০টির বেশি বিষয় রয়েছে। কেবল কম্পিউটারবিজ্ঞান–সংক্রান্ত বিষয় রয়েছে কমপক্ষে ১০টি। কম্পিউটারবিজ্ঞান, কম্পিউটার কৌশল, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার ও কমিউনিকেশন, কম্পিউটার ও ইলেকট্রিক্যাল, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি। এগুলোর সূক্ষ্ম পার্থক্যই–বা ছেলেমেয়েরা কেমনে জানবে? কাজেই ওরা ইলেকট্রিক্যাল না কম্পিউটার, সিভিল না মেকানিক্যাল, অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি না কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং—এসব নিয়ে দ্বিধায় থাকে ভর্তি হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত।

তার ওপর আছে কোথায় পড়বে? ঢাবির সিএসইতে পড়বে নাকি বুয়েটে ইইই, বিইউপির বিবিএ নাকি কুয়েটে সিএসই, নর্থ সাউথে ইকোনমিকস নাকি রুয়েটে একটা কিছু? শাহজালালে স্থাপত্য নাকি চুয়েটে? বুয়েটে কেমিক্যাল নাকি বুটেক্সে টেক্সটাইল কেমিক্যাল? হোম ইকোনমিকস কলেজের রিসোর্স ইউটিলাইজেশন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপের সঙ্গে ড্যাফোডিলের ইনোভেশন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপেরই–বা পার্থক্য কী?

কেমন করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত? কোন কোন বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া উচিত? ঘরের কাছের বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অনার্স ভালো না ঢাকায় এসে মেসে থেকে পড়া ভালো? এ প্রশ্নগুলোর জবাব খোঁজার আগে আমি বরং আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা একটু বলে নিই।

আজ থেকে ৩৫ বছর আগে আমি এইচএসসি পাস করি। আমাদের ইন্টারের পুরো সময়ে আমাদের পাড়ার এক সিনিয়র, বাদল ভাই (প্রকৌশলী, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী) দেখা হলেই বলতেন, ফিজিকস-কেমিস্ট্রি-ম্যাথ। সে সময় বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় কেবল এই তিন বিষয়ে পরীক্ষা হতো। বাংলা বা ইংরেজির কিছু থাকত না। আর বাদল ভাইয়ের কাছে মেধাবী শিক্ষার্থীর অর্থই হলো বুয়েটে চান্স পাওয়া! তিনি আমাকে সে সময় গণিত বা ফিজিকসের বিভিন্ন বিষয় দেখিয়ে দিতেন। তাঁর কারণে আর একটু হলে আমি এইচএসসিতে এই তিন বিষয়ে লেটার মার্কসহ ফেল করে যেতাম, কারণ আমার বাংলা ও ইংরেজির প্রস্তুতি ছিল কোনো রকম। প্রায় দুই বছর, পুরো এইচএসসির সময় আমি বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষাকে সামনে রেখে পড়াশোনা করেছি। এ জন্য এইচএসসির সাজেশন খুঁজিনি। চট্টগ্রাম কলেজের রসায়নের অধ্যাপক গুরুপদ পালিত এবং পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক মোজাম্মেল হক স্যারকে রাজি করিয়েছি যেন তাঁরা দুজন আমাকে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান পড়াতে রাজি হোন। এইচএসসিকেন্দ্রিক পড়াতেন না বলে তাঁদের প্রাইভেট শিক্ষার্থী খুবই কম ছিল। কিন্তু সেটাই ছিল আমার জন্য সোনায় সোহাগা। এই দুই স্যারের কাছে আমি রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে পারতাম। কারণ, আমার কানের কাছে বাজত বাদল ভাইয়ের আপ্তবাক্য ‘বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার কোনো সাজেশন নেই’।

এসব বলার অর্থ হলো এইচএসসি পড়ার সময়েই বাদল ভাইয়ের কারণে আমার মনোজগৎ বুয়েটে পড়ার জন্য তৈরি হয়ে যায়। আমাদের সময় বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার ফরমেই নিজের পছন্দের বিভাগের নাম লিখতে হতো। ফরম নিতে এসে এসে শুনলাম, সবার পছন্দ হলো ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। মানে সেটা হল ফার্স্ট চয়েজ। কিন্তু তখন জানতাম না ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যাপারটা কী? সেটাই বা কেন সবার প্রথম পছন্দের। ফরম পূরণ করার আগে আমার পুরকৌশলী চাচার পরামর্শ নিতে গেলে তিনি বলেছিলেন, ‘ইলেকট্রিক্যাল পড়ে তো চাকরি পাবে না। ইঞ্জিনিয়ারিং হলো সিভিল। অনেক চাকরি।’ কিন্তু আমি স্রোতের বাইরে থাকতে রাজি হইনি। কাজেই ইলেকট্রিক্যালই প্রথম পছন্দ দিয়ে সেটাই পড়েছি শেষ পর্যন্ত বুয়েটে।

মেডিকেল অবশ্য কলেজ পছন্দটা কঠিন ছিল না। কারণ, হাতে গোনা কয়েকটা মেডিকেলের মধ্যে ঢাকারটা সবার আগের ও বনেদি। এরপর বাড়ির কাছের চট্টগ্রাম মেডিকেল এভাবে দেওয়া যেত।

ঢাকা বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল আমার বন্ধুদের বুয়েট-মেডিকেলের বাইরের অপশন। আমরা যারা চট্টগ্রামে বড় হয়েছি, আমরা এমনকি জাহাঙ্গীরনগর বা রাজশাহীর অপশনও ভাবতাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তখন বিভাগওয়ারি পরীক্ষা হতো। আমাদের মধ্যে যাদের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শখ, তারা অ্যাপ্লাইড ইলেকট্রনিকসকে এগিয়ে রাখতাম দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর জন্য।

আমাদের কমার্স বন্ধুদের জন্য অপশন বেশি ছিল না। মার্কেটিং, ফিন্যান্স অ্যাকাউন্টিং—এই তিন বিষয়ের যেকোনো একটিতে অনার্স। আইবিএতে তখন আন্ডারগ্র্যাড ছিল না। কাজেই অপশন নেই। আর তিন অনার্সের বাজার কমবেশি একই রকম। যেকোনো একটা পড়লেই হবে।

কলা বিভাগের অনার্সের মধ্যে তখন অনেক অপশন নেই। ইংরেজি বরাবরের মতো এগিয়ে। এরপর অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন এবং অন্যান্য বিভাগ। আমাদের সময় ভর্তি পরীক্ষা আজকের মতো এত প্রতিযোগিতামূলক ছিল না। আমরা মোটামুটি জানতাম, আমাদের পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়তে পারব। আরও সুযোগ ছিল। পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় বা বিষয় না পেলে পরের বছর আবারও ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া যেত।

কিন্তু এখন?

যা করতে হবে একবারেই। সব সিদ্ধান্ত নিয়েই ভর্তি হতে হয়। আর এখনকার ছেলেমেয়েদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভাগ নির্বাচনের পুরোটা হয় পরের মুখে ঝাল খেয়ে!

এইচএসসি পর্যন্ত পড়ালেখার যে স্টাইল, সেটি এক রকম আর অনার্স কোর্স সম্পূর্ণ অন্য রকম। কারণ, সেটা বিশেষায়িত। অনেক কিছু পড়ার সুযোগ সেখানে থাকে না। এইচএসসিতে গণিত করতে ভালো না লাগলে কয়েক দিন ফিজিকসে ডুব মারা যায়। কিন্তু যে কিনা ম্যাথে অনার্স করবে, তার খাই না খাই ম্যাথই তো করতে হবে!

এমন একটা খাই না খাইয়ের সিদ্ধান্ত কি আমাদের শিক্ষার্থীরা যথাযথভাবে নিতে পারে? নাকি তারা এখনো জনপ্রিয়তা, বাবা-মায়ের পছন্দ কিংবা আমার মতো ‘বাদল ভাই’-এর পছন্দের নিয়ে নেয়? পশ্চিমা বিশ্বে তাই এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীকে নিতে দেয়। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো প্রথম বর্ষে সবাই প্রায় একই রকম জিনিস পড়ে। তারপর ঠিক করে কোনোটাতে স্পেশালাইজেশন করবে। দুই বিষয়েও মেজর করা যায়। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শাবিপ্রবিতে ডাবল মেজর করা যায় বলে শুনেছি।

আমাদের অবশ্য আর সেখানে ফেরত যাওয়ার উপায় নেই। কাজেই বিষয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় সঠিকভাবে বাছাই করার জন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের কি সব তথ্য থাকে? তারা কি হুজুগে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়? কেন তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, যদিও–বা তার পছন্দের বিষয় সে পায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে? এ কি কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের জন্য? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশে এখন ১৫১টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সে কারণে আমার ধারণা, নিজের পছন্দের বিষয় না হলেও গোটা বিশেক বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে থাকে। যদি না সেটি বায়োটেক, আর্কিটেকচার বা এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপের মতো না হয়। সেখান থেকে কোনোটা তার পছন্দ করা উচিত?

প্রথমে শুরু করা যাক বিষয় ভাবনা। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের দিয়েই শুরু করি। আমাদের দেশে বেশির ভাগ (কী আশ্চর্য এখনো) বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর প্রথম পছন্দ মেডিকেল বা প্রকৌশল। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেলের বেলায় কলেজটি কোথায় সেটিও ভাবনার মধ্যে নিতে হবে। তুমি যদি সামনের সারির সরকারি মেডিকেল কলেজে সুযোগ না পাও, তাহলে এই বিষয়টাকে সবচেয়ে বেশি নম্বর দাও। আমাদের দেশে এখন অনেকগুলো মানসম্মত বেসরকারি মেডিকেল কলেজ আছে। কাজে যদি আর্থিক সামর্থ্যের ব্যাপারটা জরুরি না হয়, তাহলে তোমার বাড়ি থেকে দূরবর্তী সরকারি কলেজের চেয়ে বাড়ির কাছের সামনের সারির মেডিকেল কলেজকে প্রাধান্য দাও।

হবু প্রকৌশলীদের জন্য এখন মধুর সমস্যা। বুয়েট ছাড়াও আরও চারটি উয়েট (UET) আছে। এ ছাড়া প্রায় বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি আছে। ফলে তোমার কিন্তু অনেক পছন্দ। আমার নিজের ধারণা, এগুলোর মধ্যে গুণগতমানের ফারাক অনেক বেশি নয়। ধরা যাক তোমার ইচ্ছে কম্পিউটারবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার। কিন্তু তুমি সুযোগ পেয়েছে বুয়েটের কেমিক্যাল, ঢাবির ইলেকট্রিক্যাল আর শাবিপ্রবির কম্পিউটারে। অনেকেই তোমাকে বলবে, ‘আরে বাবা বুয়েট তো বুয়েট। কেমিক্যালে হয়েছে তো কী হয়েছে? ওটাই পড়ো।’ আমি তোমাকে এ পরামর্শ দেব না। আমি তোমাকে শাবিপ্রবিতেই পড়তে বলব। মোদ্দাকথা হলো আমি তোমাকে প্রতিষ্ঠানের চেয়ে নিজের পছন্দে জোর দিতে বলব। সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ কমবেশি একই রকম। কাজেই এখানে অন্যান্য ফ্যাক্টর অনেক কম। তবে যখন তুমি যদি প্রকৌশল বা স্থাপত্য পড়তে চাও এবং ভবিষ্যতে একজন প্র্যাকটিসিং প্রকৌশলী বা স্থপতি হতে চাও বা সেটির দরজা খোলা রাখে চাও, তাহলে তোমাকে আর একটা খোঁজ জরুরিভাবে নিতে হবে। সেটি হলো তোমার নির্বাচিত বিশ্ববিদ্যালয়-বিষয়ের অ্যাক্রিডেশন। এটি খুবই জরুরি। প্রকৌশল হলে খোঁজ নাও ওই বিভাগের ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের (আইইবি) অ্যাক্রিডিশন আছে কিনা। এটি থাকলে তুমি পাস করার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে সহযোগী সদস্য (অ্যাসোসিয়েট মেম্বার) হতে পারবে এবং এর দুই বছর পর তুমি মেম্বার হতে পারবে। তুমি যখন কেবল মেম্বার হবে, তখনই তুমি কেবল একজন প্র্যাকটিসিং প্রকৌশলী হিসেবে স্বতন্ত্রভাবে একটি প্রকৌশল দলিলে স্বাক্ষর করতে পারবে। স্থাপত্যের বেলায় এই অ্যাক্রিডিশন দেয় ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট বাংলাদেশ (আইএবি)। আমার জানামতে, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের এই স্বীকৃতি এখনো হয়নি। ফার্মেসি নিয়ে যারা পড়বে, তাদেরও কিন্তু এই বিষয়ের খোঁজ নিতে হবে। কেবল ফার্মেসি কাউন্সিলের অধিভুক্ত হলেই তুমি প্রফেশনাল ধাপগুলো সময়মতো পার হতে পারবে।

ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং-ফার্মেসির বাইরেও বিজ্ঞানের পড়ার বিষয় অনেক। এখন এগিয়ে আছে জেনেটিক বিদ্যা ও মলিকিউলার সায়েন্স। অনেক পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি পড়া যায়। তবে এগুলোর আসনসংখ্যা খুবই সীমিত। ভর্তির আগে খোঁজ নাও ওখানকার ল্যাবগুলো কেমন, স্যার-ম্যাডামরা ল্যাবে শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানায় কি না, বাড়তি সময় ল্যাবে থাকা যায় কি না। বিদেশের সঙ্গে ল্যাবের কোলাবরেশন আছে কি না। তুমি যদি এ ধরনের বিষয়কে বেছে নাও, তাহলে আমি ধরে নিচ্ছি, তুমি গবেষণাকে প্রাধান্য দিতে চাও সামনের দিনে। সে জন্য এগুলো খুবই জরুরি।

আমাদের দেশের কর্মবাজারের কথা যদি ভাবো, তাহলে তোমার জন্য খুব ভালো চয়েস হলো টেক্সটাইল, লেদার ও সিরামিকস নিয়ে পড়াশোনা করা। তৈরি পোশাকশিল্প আমাদের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত এবং আগামী ১০ বছর পর্যন্ত নিশ্চিন্তে তাই থাকবে। কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারণে সেসবে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মীর চাহিদা এখনকার চেয়ে অনেক গুণ বেশি বেড়ে যাবে। ফলে, তোমার কাজ দেখানোর সুযোগও বাড়বে। চামড়াজাত শিল্পের বাজার এখন আরও বাড়ছে। সে সঙ্গে আমাদের দেশেও নিজেদের ব্র্যান্ডের অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আনাগোনা আরও বাড়বে। পাস করার পর তুমি ইচ্ছে করলে নিজেও একটা কিছু করতে পারবে। আমার পরিচিত লেদার ইঞ্জিনিয়ারদের বেশির ভাগই নিজেদের প্রতিষ্ঠান খুলে বসে আছেন। সিরামিকসের ভবিষ্যৎ ভালো।

আমাদের দেশে শিক্ষার একটি বড় জোয়ার হয়েছে। কাজে বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলোতে এখন অনেক শিক্ষকের দরকার হয়। কাজে যারা গণিত, রসায়ন বা ভৌত বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পড়তে চাও, তাদেরও সুযোগ অবারিত। ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত বিশ্বের কাতারে যেতে হলে দেশের রিসার্চ খাতের অনেক উন্নতি করতে হবে। কাজেই বিজ্ঞানী হিসেবে যারা নিজেদের দেখতে চাও, তারাও অবলীলায় নিজেদের পছন্দে পড়তে পারো। জীববিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীরাও সহজে বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করতে পারো। কারণ, আমার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাবি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে খুব একটা বেশি ফারাক নেই। বন-বনানী নিয়ে যারা পড়তে চাও, তাদের প্রথম পছন্দ ফরেস্ট্রি। গুটিকতক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি পড়ার সুযোগ আছে। সেগুলোর একটিতে ভর্তি হতে পারো।

বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলোতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর পরীক্ষাগারগুলোর এখনো অনেক বেশি উন্নত হয়নি। তোমার সিলেবাসের কাজগুলো তুমি হয়তো করতে পারবে, কিন্তু নিজে থেকে বাড়তি কিছু করতে চাইলে সেটা সম্ভব নাও হতে পারে।

কমার্স ফ্যাকাল্টি মানে এখন বিবিএ! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউট তোমার প্রথম পছন্দ সেটা আমি জানি। সেখানে না হলে তুমি তোমার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখতে পারো। কয়েকটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে এখন বিজনেস ফ্যাকাল্টিতে অনেক ভালো ফ্যাকাল্টি রয়েছে। এসব ভার্সিটির পড়াশোনার স্ট্যান্ডার্ডও অনেক ভালো। বিশেষ করে আমরা যখন কর্মবাজারে দেখি, তখন প্রাইভেট ভার্সিটির অনেককেই এগিয়ে থাকতে দেখছি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এগুলো বিবেচনা করলে ভালো হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনেক কলেজও এসব বিষয়ে অনেক ভালো। কাজেই বিবেচনায় তুমি সেসব কলেজকেও রাখতে পারো। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল সময়ের ব্যাপারটা অনেক লম্বা।

মানবিক পড়ুয়াদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ইংরেজি, জেন্ডার স্টাডিজ, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চাহিদা বেশি। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ইংরেজিতে পড়তে পারো। অন্য বিভাগগুলো সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। খোঁজ নিতে হবে এবং সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।

দেশে অনেক বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয় এখন চালু হচ্ছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে তুমি পাস করতে করতেই চাকরি পেয়ে যেতে পারো, কারণ দেশে গবাদিপশুর চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞের চাহিদার এক কোনাও এখন পর্যন্ত পূরণ হয়নি। পড়তে পারো দেশের হাতে গোনা নার্সিং ইনস্টিটিউটে। আমাদের দেশেরই বটে, সারা বিশ্বে নার্সিং পেশার কদর বাড়ছে, চাহিদাও বাড়ছে।

অনেকই এখন উদ্যোক্তা হতে চায়। আমার জানামতে, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনোভেশন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপের অনার্স কোর্স রয়েছে। শুনেছি, হোম ইকোনমিকসে ‘রিসোর্স ইউটিলাইজেশন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপের ওপর অনার্স করা যায়।

দেশের ১৫১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৫০টির বেশি বিষয়ের মধ্যে বিষয় ও বিশ্ববিদ্যালয় বাছাইয়ের ব্যাপারে কোনো একটি ফর্মুলা দেওয়ার মতো জ্ঞান আমার নেই। আমি কেবল আমার জানাশোনা গণ্ডি নিয়ে আলোচনা করেছি।

আমরা ভাবছি, এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের পরামর্শ সহায়তা দেওয়ার কোনো প্ল্যাটফর্ম করা যায় কি না। যদি যায়, তাহলে সেটিও আমরা প্রথম আলোর মাধ্যম তোমাদের জানিয়ে দেব।
সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

ঈদ মোবারক।

মুনির হাসান: প্রথম আলোর যুব কার্যক্রমের প্রধান