সহমর্মিতার শিক্ষায় এল স্বীকৃতি

‘আরে ও ক্লাসে আসে না, আগেরবার প্রজেক্টে কাজ করেনি, ওকে নিস না।’ —দল বেঁধে ক্লাসে কোনো কাজ করতে গেলে অনেক সময়ই কারও ব্যাপারে আমরা চটজলদি এভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাব। কিন্তু ক্লাসে অনুপস্থিত থাকে বলে যে বন্ধুটিকে আপনি আজ দলে নিলেন না, হয়তো তিনি কোনো সমস্যায় পড়েছেন বলে নিয়মিত ক্লাসে আসতে পারছেন না। ব্যক্তিগত অসুস্থতা বা পারিবারিক সমস্যার মতো ব্যাপারগুলোও তো হতে পারে তাঁর অনুপস্থিতির কারণ! কিন্তু তাঁর প্রতি সহমর্মী না হয়ে তাঁকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিই আমাদের যত তাড়া!

সাফল্যের পেছনে শশব্যস্ত হয়ে ছুটতে থাকা আশপাশের মানুষকে দেখেই ভিন্ন কিছু করার কথা ভাবেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ল্যাঙ্গুয়েজের শিক্ষক মামুনুর রশীদ। নিজের ছাত্রজীবনে এবং শিক্ষকতার সময় তিনি কাছ থেকে দেখেছেন এ দেশের তরুণসমাজকে, দেখেছেন ইদানীং নিজের সাফল্য ছাড়া আর কিছুই যেন ভাবতে পারছে না মানুষ। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে পড়ার সময় বিভিন্ন দেশের মানুষের সংস্পর্শে আসেন তিনি। পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতিতে সহমর্মিতার চর্চা কীভাবে হচ্ছে আর কেন তা দরকার, তা বৈশ্বিক পরিসরে আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করেছেন তখন। সেই উপলব্ধিরই বাস্তবায়ন শিক্ষাবিষয়ক প্রকল্প ‘শেপিং দ্য ইয়ুথ উইথ এমপ্যাথি এডুকেশন’, যা তাঁকে এনে দিয়েছে জাতিসংঘের সিটওন (দ্য কমিটি অন টিচিং অ্যাবাউট দ্য ইউনাইটেড ন্যাশনস) কমিটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। জাতিসংঘ থেকে শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান নিয়ে কাজ করা শিক্ষাবিদদের প্রতিবছর এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

মামুনুর রশীদ মনে করেন, দূর থেকে সহানুভূতি জানানোর চেয়ে সহমর্মী হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো অনেক বেশি জরুরি। আর এ জন্য প্রথমেই প্রয়োজন অন্যের দুঃখ উপলব্ধি করা, প্রথমেই কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে ফেলে ভুক্তভোগীর অবস্থান থেকে তাঁকে বুঝতে শেখা। এ ভাবনা থেকেই তিনি শিক্ষাব্যবস্থায় সহমর্মিতার চর্চা শুরু করতে চেয়েছেন। মামুনুর রশীদ উদ্ভাবিত প্রকল্পটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহমর্মিতা চর্চার একটি কার্য উপযোগী মডেল, যা ইতিমধ্যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ল্যাংঙ্গুয়েজেসের ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ক্লাসগুলোতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় শিক্ষার্থীরা তাঁদের চারপাশের বৈষম্যের শিকার হওয়া মানুষ, তাঁদের মনোজগৎ নিজের অনুভূতির মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করে, তাঁদের প্রতি আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত এবং তাঁদের উন্নয়নে কী করা যায়, তা নিয়ে ভাবে ও বিস্তারিত আলোচনা করে। প্রকল্পটি নিয়ে তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে এত যুদ্ধ-হানাহানির মূলে রয়েছে অন্যের প্রতি আমাদের সহমর্মিতার অভাব, অন্যকে বুঝতে না পারা। তাই আমি দেশে-বিদেশে আরও তৃণমূল পর্যায় থেকে আমার এ প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে চাই। মানুষ যদি শৈশব থেকেই শিক্ষাক্ষেত্রে সহমর্মিতা চর্চার সুযোগ পায়, তবে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সম্মান জানানো, অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে পারার মতো গুরুত্বপূর্ণ মানবিক গুণ সহজেই আয়ত্ত করতে পারবে। আর তখনই এ পৃথিবী হবে শান্তি ও সম্প্রীতির।’