ক্যানসার যাঁকে সাহসী করেছে

নূর এ সাফী আহনাফ। ছবি: সংগৃহীত
নূর এ সাফী আহনাফ। ছবি: সংগৃহীত

যে শরীরে ক্যানসার ছড়ায়, মৃত্যু তাকে হাতছানি দেয়, মানসিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল করে ফেলে। চিকিৎসা, কেমোথেরাপির বিপুল খরচ বহন করতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে অনেক পরিবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নূর এ সাফী আহনাফ এই লড়াই সম্পর্কে খুব ভালো করে জানেন। কারণ, তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকেমিয়া নামের ঘাতক ব্লাড ক্যানসার।

অন্য অনেক রোগীর মতো আহনাফেরও হয়তো মানসিকভাবে ভেঙে পড়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু অন্য একটা পথ বেছে নিয়েছেন তিনি। নিজে হতাশ হননি, অন্য কোনো ক্যানসার রোগী যেন হতাশ হয়ে না পড়ে, সেই ব্রত নিয়ে পথ চলছেন তিনি। নিজেই ছুটে যান ক্যানসার রোগীর ঠিকানায়, আশার বাণী শোনান, পাশে থাকেন, নিজের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নেন। ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ, কেমোথেরাপি, শারীরিক অসুস্থতা, দুর্বলতা—এসবের মধ্য দিয়েই তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে লিউকেমিয়া অ্যান্ড লিম্ফোমা সোসাইটি অব বাংলাদেশ নামের সংগঠনটি গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি।

২০১৩ সালে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষে পড়ার সময় শরীরে মরণব্যাধি বাসা বাঁধে। পরিবার ও বন্ধুরা জানলেও নিজের রোগ সম্পর্কে জানতেন না আহনাফ। শুধু কখনো কখনো বাবাকে কাঁদতে দেখতেন। কিছু না বুঝেই সান্ত্বনার বাণী শোনাতেন বাবাকে। কিন্তু তখনো জানতেন না, কান্নার কারণ তিনিই। কলেজে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে খুব সক্রিয় ছিলেন, নিয়মিত বিতর্ক করতেন, ছিলেন ডিবেট সোসাইটির প্রধান। ক্যাম্পাসে পরিচিত অনেকেই তাঁর রোগ সম্পর্কে জেনেছিলেন। আহনাফের জন্য দোয়া চেয়ে পরিচিতদের মধ্যে কেউ একজন প্রথম ফেসবুকে পোস্ট দেন। একদিন দুপুরে ফেসবুকের নিউজফিডে ঘুরতে ঘুরতে খবরটি প্রথম চোখে পড়ে তাঁর।

সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে আহনাফ
সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে আহনাফ

রোগাক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক রোগীর সঙ্গে দেখা, কথা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় হয় আহনাফের। দারিদ্র্য কিংবা পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে চিকিৎসা করাতে পারছেন না, এমন অনেক রোগীকেও তিনি দেখেছেন। মৃত্যু হবে জেনে এই পরিবারের সদস্যরা হাল ছেড়ে দেন। তখন থেকেই কিশোর আহনাফের মনে হতে থাকে, ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য একটা কিছু করা দরকার। অন্তত হাসিমুখে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে মানসিক সাহস জোগানোর কাজটাও তো করা যায়, প্রথমে এমন ভাবনা থেকে আরও কিছু উদ্যমী রোগীকে নিয়ে ২০১৬ সালে শুরু করলেন কাজ। এরপর যুক্ত হলো আরও নানা কার্যক্রম—চিকিৎসাসংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য জানানো, চিকিৎসক বা চিকিৎসাকেন্দ্রের খবর দেওয়া, রোগীকে মানসিকভাবে সাহস দেওয়া, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। পরিধিটা বড় হয় আরও। তখন দরিদ্র রোগীদের সহায়তার জন্য সংগঠনের কর্মীরা প্রয়োজনে বিভিন্ন ব্যাংক, বিমা, ব্যবসায়প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। কিংবা কীভাবে যোগাযোগ করা যায়, সেই পথ বাতলে দেন। এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত গরিব রোগীকে সাহায্যের নেপথ্যে কাজ করেছে এই প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া সমাজসেবা অধিদপ্তর ও সমাজকল্যাণ সংস্থা থেকে ক্যানসার রোগীদের এককালীন ভাতা পাওয়ার জন্য আবেদন করার ব্যাপারে সহযোগিতা করে তারা। শুরুতে শুধুই ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এখন সব ধরনের ক্যানসার রোগীর পাশে এসে দাঁড়ায় আহনাফদের এই সংগঠন। ১২ থেকে ১৫ জন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর স্বেচ্ছাশ্রমে যাত্রা শুরু হয়েছিল, এখন রোগী ও তাঁদের স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী মিলিয়ে সংগঠনের সদস্যসংখ্যা প্রায় আট হাজার।

এখানেই থেমে নেই। একজন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর স্বজন ঢাকার বনশ্রীতে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া অ্যান্ড ক্যানসার হাসপাতাল নামে হাসপাতাল চালু করেন এ বছরের মে মাসের শুরুতে। সেখানে ‘ডিরেক্টর অব পেশেন্ট কেয়ার’ পদে নিয়োগ পান আহনাফ। আহনাফ জানালেন, এখানে কিছুটা স্বল্প মূল্যে ওষুধ সরবরাহ এবং দূরের রোগীদের জন্য কম খরচে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

নূর এ সাফী আহনাফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শেষ বর্ষের ছাত্র। যুক্ত আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির সঙ্গে। যুক্ত আছেন আরও নানা স্বেচ্ছাসেবী কাজে। দীর্ঘদিন ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করা আহনাফ পড়াশোনায়ও ভালো ফল ধরে রেখেছেন। এসএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়েছিলেন বৃত্তিসহ। পরবর্তীকালে ক্যানসার নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে এইচএসসিতেও তিনি একই ফল অর্জন করেন এবং ঢাকা বোর্ডে তাঁর অবস্থান ছিল মেধাতালিকায় ৭৬তম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় তাঁর অবস্থান ছিল ২৩২তম। সব সময় হাসিখুশি আহনাফ নিজেকে নানা কাজে ব্যস্ত রাখতে পছন্দ করেন।

আহনাফ বলেন, ‘যত দিন বাঁচব, তত দিন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য কাজ করতে চাই। তাঁদের মুখে হাসি দেখতে ভালো লাগে বলেই কাজ করি। আমি খুব শক্ত একটা দল রেখে যেতে চাই, যারা ক্যানসার রোগীদের নিয়ে কাজ করবে, তাঁদের পাশে দাঁড়াবে। আর মারা যাওয়ার আগে আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক মানের ক্যানসার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যেখানে খুবই স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা ও সেবা দেওয়া হবে।’

এই প্রবল ইচ্ছা সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন আহনাফ। অসুস্থতায় শরীর ভেঙে পড়তে চাইলেও অন্য রোগীদের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আবার সোজা হয়ে দাঁড়ান।