ভর্তি পরীক্ষার আগে ১০ ভুল

মডেল: মায়িশা। ছবি: খালেদ সরকার
মডেল: মায়িশা। ছবি: খালেদ সরকার
উচ্চমাধ্যমিকের পর শিক্ষার্থীরা সাধারণত কোন ভুলগুলো করে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা কথা বলেছিলাম ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁরা বলেছেন, এই সময়টাতে কোন কোন বিষয় ছাত্রছাত্রীদের বিভ্রান্ত করে। ছাত্রছাত্রীদের বলা ভুলগুলো থেকে বাছাই করা ১০টি তুলে ধরেছেন তাহমিদ উল ইসলাম

১. লক্ষ্য নির্ধারণে ব্যর্থতা

এইচএসসি পরীক্ষার পর সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণে ব্যর্থ হন অনেক শিক্ষার্থীই। তাঁরা তাঁদের নিজেদের ভালো লাগার জায়গাটি বুঝতে পারেন না। সিদ্ধান্ত নেন পরিবারের চাপে পড়ে। অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে একাধিক জায়গার প্রস্তুতি একসঙ্গে নেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জাওয়াদ আবদুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অনেকেই একসঙ্গে একাধিক নৌকায় পা দেয়। এর ফলে কোনো প্রস্তুতিই তারা ভালোভাবে নিতে পারে না। এটাই পরে ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’

২. অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কিংবা আত্মবিশ্বাসের অভাব

অনেকের মধ্যে দেখা যায় অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস; আবার অনেক শিক্ষার্থীই পর্যাপ্ত আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভালো করতে পারেন না ভর্তি পরীক্ষায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আদহাম হোসেনের ভাষায়, ‘ভর্তি পরীক্ষায় অনেক প্রতিযোগী দেখে অনেকেই ভয় পেয়ে যায়, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এই আত্মবিশ্বাসহীনতা তাদের হতাশার দিকে ঠেলে দেয়। আবার মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসও ক্ষতিকর। ভালো ফলের জন্য দরকার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রচেষ্টার সংকল্প।’

 ৩. না বুঝে মুখস্থ করার প্রবণতা

ভর্তি পরীক্ষার মৌসুমে বিষয়ভিত্তিক গভীর জ্ঞান অর্জন না করে মুখস্থ করার ঘোর বিরোধী ২০১৭ সালে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকারী স্বপ্নীল আবদুল্লাহ, ‘না বুঝে মুখস্থ করে সাময়িকভাবে কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু পুরো বইয়ের ওপর পরীক্ষা হলে অথই জলে পড়তে হয়। তখন আর মুখস্থ করে পার পাওয়ার সুযোগ থাকে না। যদিও একবার ভালোভাবে বিষয়টি বুঝে নিলে তা সহজেই মনে পড়ে যায়।’

৪. দীর্ঘসূত্রতা

‘ভবিষ্যতে পড়ব বলে পড়া জমিয়ে রাখা এবং সময়ের সঠিক ব্যবহার না করা একটি বদ অভ্যাস। এর ফলে শিক্ষার্থীদের শেষ সময়ে অতিরিক্ত চাপ নিতে হয়, যা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না।’ বলছিলেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী আশিক হৃদয়। ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য সময় থাকে সীমিত। এবং এই সীমিত সময়ের সদ্ব্যবহার করাটা সফলতার জন্য অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন তিনি। 

৫. গ্যাজেটের অতি ব্যবহার

সময় যেহেতু সীমিত, তাই এর সঠিক ব্যবহারের দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। অনেকেই এই সময়টা অপচয় করে থাকেন স্মার্টফোন, কম্পিউটার ও অন্যান্য যন্ত্র ব্যবহারে, যা তাঁদের সফলতার পথে একটি বড় বাধা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইজুন নাহারের মত, ‘এটা সত্যি যে গ্যাজেট ব্যবহার করে পড়াশোনার অনেক ব্যাপারে সাহায্য নেওয়া যায়। কিন্তু গ্যাজেটের অতিরিক্ত ব্যবহার মনোযোগের বিঘ্ন ঘটায়, নষ্ট করে সময়ও।’ তিনি মনে করেন, গ্যাজেটের ব্যবহার একদম বন্ধ করে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং এর পরিমিত ব্যবহার শিক্ষার্থীদের নতুন তথ্য জানার মাধ্যমে সচেতন হতে সহায়তা করে। 

৬. অতিমাত্রায় কোচিং–নির্ভরতা

শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ মনে করে, শুধু একটি ভালো কোচিংয়ে পড়তে পারাটাই যথেষ্ট। কিন্তু ভর্তিযুদ্ধে ভালো করতে হলে নিজের চেষ্টা ও পরিশ্রমের দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মীর আকিব জাওয়াদের মতে, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাইলে কোচিং করতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। কোচিং মূলত একটি নির্দেশনা দেয়। তবে পড়ার কাজটা নিজেরই।’ 

৭. অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা

সত্যিকারের প্রতিযোগিতা মূলত নিজের সঙ্গে। অথচ অনেক শিক্ষার্থীই অন্যের সঙ্গে অতিমাত্রায় তুলনা করেন নিজেকে; এর ফলে হতাশা ঘিরে ধরে তাঁদের। এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রূপন রেশাদ মনে করেন, অন্যদের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করাটা বোকামি, কেননা এটি হাল ছেড়ে দেওয়ার পর্যায়ে নিয়ে যায় মানুষকে। তাঁর মতে, নিজের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করাটাই উত্তম। 

৮. পর্যাপ্ত অনুশীলনের অভাব

ভর্তি প্রস্তুতিতে প্রয়োজন প্রচুর অনুশীলন। অনুশীলনের মাধ্যমে কেটে যায় আত্মবিশ্বাসহীনতা, বাড়ে দক্ষতাও। আর এ বিষয়ে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আসিমা কামাল শোনান তাঁর গল্প, ‘ভর্তি মৌসুমে আমি প্রস্তুতি নিয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটের জন্য। কিন্তু পর্যাপ্ত অনুশীলন করতে পারিনি। আর এর ফলাফল মোটেও ভালো হয়নি। তাই ভর্তি-ইচ্ছুকদের জন্য আমার পরামর্শ হলো, এইচএসসি পরীক্ষার পরপরই পড়া শুরু করতে হবে। অনুশীলন শুরু করতে হবে প্রথম দিন থেকেই। প্রতিটি বিষয়ে দিতে হবে পর্যাপ্ত মনোযোগ।’ 

৯. অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে মনোযোগ বেশি দেওয়া

ভর্তি পরীক্ষার মৌসুমে হাতে সময় থাকে সীমিত। তাই পড়তেও হয় বাছাই করে। এ বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায় পূর্ববর্তী বছরের প্রশ্ন দেখলে, যা অনেক শিক্ষার্থীই করে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফারহানা রশিদ বলেন, ‘ভর্তি পরীক্ষায় কিছু বিষয় ঘুরেফিরে আসে। সেগুলোর দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। আর মৌলিক ধারণাগুলোও থাকা চাই পরিষ্কার।’

১০. অন্যের পছন্দে বিষয় মনোনীত করা

অনেক ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় অন্যের পছন্দ অনুযায়ী বিষয় বেছে নেন। বিষয়টির প্রতি তাঁর ভালোবাসা আছে কি না, সেদিকে নজর দেন না। এর ফলে কয়েক সেমিস্টার পরেই দেখা যায় হতাশা। আশানুরূপ ফল অর্জন করাও হয়ে ওঠে কঠিন। এ বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তাবাসসুম ইসলাম বলেন, ‘এখন অনেকেই গতানুগতিকতার বাইরের বিষয়গুলো পড়তে চান। অনেকের পছন্দের বিষয় থাকলেও দেখা যায় তা অভিভাবকদের প্রত্যাশার সঙ্গে মিলছে না। এ রকম পরিস্থিতিতে সাধারণত মানুষ নিজের পছন্দের বিষয় বেছে না নিয়ে অন্যের মত দ্বারা প্রভাবিত হয়।’

নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে
ড. বি এম মইনুল হোসেন
সহযোগী অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে, শুধু ‘পড়তে ভালো লাগে’—এই ভাবনা থেকে একজন শিক্ষার্থীর জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করে ফেলা কঠিন। বাস্তবতা হচ্ছে, কী লক্ষ্য নির্ধারণ করছি, কোথায় ভর্তি হচ্ছি, সেটার ওপর নির্ভর করছে তার ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার। আর আমাদের দেশের বাস্তবতায়, একজন শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ারের সঙ্গে শুধু তার নিজের জীবন নয়, যুক্ত থাকে গোটা পরিবার। অতএব, নিজের ভালো লাগার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয়, শিক্ষক, প্রতিবেশীদের মধ্যে যাঁরা উচ্চশিক্ষার মধ্য দিয়ে গেছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে। সবার সঙ্গে পরামর্শ করতে সমস্যা নেই। কিন্তু সবার পরামর্শ বিবেচনা করে, পরবর্তী সময়ে যতটুকু সম্ভব নিজের ভালো লাগার বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে, লক্ষ্যটা নিজেকেই নির্ধারণ করতে হবে। পরীক্ষা প্রস্তুতির অংশ হিসেবে, অনেকের ক্ষেত্রে কোচিং করাটা বেশ কাজে আসে। তবে, সেটা যে প্রাতিষ্ঠানিক কোচিংই হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। যে কেউ, এমনকি নিজের পরিবারের সদস্যরাও ‘কোচ’ হিসেবে নির্দেশনা দেওয়া বা মূল্যায়ন করার কাজটুকু করতে পারেন। এটা ঠিক যে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই আরেক পরিশ্রমসাধ্য কাজ—ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করতে হয়। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে হলে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপারটিকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এমনকি ভর্তি কোচিং বা পরীক্ষার উদ্দেশ্যে যদি সাময়িকভাবে নিজের ঠিকানা পরিবর্তন করতে হয়, নতুন জায়গা বা নতুন পরিবেশে স্বাভাবিক কৌতূহলটাকেও প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই; কেবল মূল কাজ—ভর্তি পরীক্ষার পরই সেসব দিকে নজর দেওয়াটা বেশি যৌক্তিক হবে। এই সময়ে যতটা একাগ্রচিত্তে প্রস্তুতি নেওয়া যাবে, ততই ভালো কিছু ফল পাওয়ার নিশ্চয়তা বেড়ে যাবে। ভর্তি পরীক্ষায়, একটি বেশি নম্বর অনেক কিছু পরিবর্তন করে দিতে পারে। এমনও দেখা গেছে যে দশমিক এক নম্বর কম থাকার কারণে কারও কারও আরাধ্য সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস, গ্যাজেট ব্যবহার যার যার নিজস্ব ব্যাপার। প্রতিটি মানুষেরই লাইফ স্টাইল তার নিজস্ব। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে বা জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টিতে যদি জীবনধারায় আংশিক পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হয়, তবে সেটা বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ, মানুষের জীবনে এই ভর্তি পরীক্ষার সময়টুকু বারবার আসবে না। ভর্তি পরীক্ষার আগে প্রস্তুতি নেওয়ার সময়টুকু এতটাই সীমিত যে এখানে দীর্ঘসূত্রতা বা দুই দিন পরে শুরু করার সুযোগ নেই। সোজা কথা হচ্ছে, এই কয়টা মাস শিক্ষার্থীদের সব পরিকল্পনা হতে হবে ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে। মনে রাখতে হবে, অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। শুধু প্রশ্নের উত্তর পারাটাই অনুশীলনের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। পরীক্ষার নিয়মকানুন জানা, ওএমআর ফরম পূরণ, পরীক্ষার দিনের প্রবেশপত্র সঙ্গে থাকা, ধৈর্যসহকারে পরীক্ষার সময়টুকু লেখা চালিয়ে যাওয়া, এগুলোও অনুশীলনের অংশ। পরিশেষে বলতে চাই, লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সবটুকু চেষ্টাই করে যেতে হবে। কোথায় ভর্তির সুযোগ পাওয়া গেল, এই মুহূর্তে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সুযোগ পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত চেষ্টাটুকু করা হলো কি না।