ভাইরাল হতে কেমন লাগে?

একতারা ব্যান্ডের সদস্যরা। বাঁ থেকে অমিত, তন্বী, দিনা, জাইম ও আজমাইন ছবি: হৃদয় তানভির
একতারা ব্যান্ডের সদস্যরা। বাঁ থেকে অমিত, তন্বী, দিনা, জাইম ও আজমাইন ছবি: হৃদয় তানভির

উচ্চমাধ্যমিক পেরোনোর পর মেয়েটি পুরো সাহস সঞ্চয় করে চট্টগ্রাম থেকে ছুটে এসেছিলেন তাঁর প্রথম প্রেমের কাছে। প্রথম প্রেম! আমরা ভ্রু কুঁচকে তাকালে শেখ দিনা হেসে বলেন, ‘নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি’। ক্যাম্পাস তাঁর কাছে ভীষণ প্রিয়। এই ক্যাম্পাসই তো তাঁকে একটা গানের দল দিয়েছে। এই দলের সঙ্গে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যালারিতে বসে দিনা গেয়েছিলেন, ‘এত যে নিঠুর বন্ধু জানা ছিল না’। গানটা ভিডিও করেছিলেন ক্যাম্পাসেরই একজন। কদিন পর দেখা গেল, ফেসবুক-ইউটিউবে তুমুল আলোচিত সেই গান। এ কালের ভাষায় যাকে বলে ‘ভাইরাল’। ‘এত যে নিঠুর বন্ধু জানা ছিল না’ যে এত সাড়া ফেলে দেবে, সেটা দিনা আর তাঁর বন্ধুদের জানা ছিল না।

অমিত রাজবংশী, এস এন তন্বী, জাইম আমান, আজমাইন মাহতাব ও শেখ দিনা—পাঁচজনের ব্যান্ড একতারা। ব্যান্ডের নাম একতারা কেন হলো, এর পেছনের ব্যাখ্যাটা সুন্দর। একতারায় যেমন একটা তারেই সুর বাঁধা যায়, ব্যান্ডটির সদস্যরা দাবি করেন, তাঁরাও তেমনি একই সুতোয় বাঁধা। দলে নতুন যোগ হওয়া জাইম আমান ছাড়া প্রত্যেকেই নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। এখানেই তাঁদের একসঙ্গে গান চর্চা, বেড়ে ওঠা কিংবা পরিচিতি পাওয়া...

একতারার এক হওয়ার পেছনে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ভূমিকার কথা বলছিলেন আজমাইন মাহতাব, ‘আমাদের এখানে সাধারণত সন্ধ্যার পর গ্যালারিতে কাউকে বসতে দেওয়া হয় না। গার্ড মামারা এসে চলে যেতে বলেন। যখন পুরো গ্যালারি ফাঁকা হয়ে যায়, তখন আমরা বসে গান গাই। আমাদের অবশ্য মামারা সরিয়ে দেন না, বরং আমাদের সঙ্গেই বসে গান শোনেন, উৎসাহ দেন। বলতে পারেন এই মামারাই আমাদের প্রেরণা।’ এই যে রাতারাতি একতারার গান ভাইরাল হয়ে গেল, ভাইরাল হতে কেমন লাগে? জানতে চেয়েছিলাম শেখ দিনার কাছে। শেখ দিনা বলেন, ‘পরিচিতি পাওয়ার একটা আনন্দ আছে। কিন্তু মামারা যখন আমাদের দেখলে হাসিমুখে কথা বলেন, মঞ্চে গান গাওয়ার সময় যখন বন্ধুরা সবাই উৎসাহ দেয়, সেটার আনন্দ আরও বেশি।’

ছোটবেলায় দিনা নাকি প্রতি শুক্রবার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কারণ, ওই দিন পাশের বাসার মেয়েটাকে গান শেখাতে আসতেন তার গানের শিক্ষক। জানালায় দাঁড়িয়ে দিনা মন দিয়ে শুনতেন। গানের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তাঁর নিজে নিজে গান শেখা। দলের বাকি সদস্যরাও কেউ ছেলেবেলায় গান শেখেননি। বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখেছেন নিজে নিজে। গানের সঙ্গেই সখ্য হলো কেন? দলের ছোটখাটো দার্শনিক অমিত উত্তরটা দিলেন, ‘গান না করে আমরা কেউ থাকতে পারি না। গানই আমাদের একসঙ্গে করেছে। তাই যা-ই করি না কেন, দিন শেষে বেহায়ার মতো গানের কাছেই ফিরে আসি।’ কথা যে সত্যি তা প্রমাণ করলেন দলের পঞ্চম সদস্য জাইম। এখন পর্যন্ত তিনবার চাকরি ছেড়েছেন ফ্যাশন ডিজাইনার জাইম। তাঁর মতে, ‘পিঁপড়া যেমন শীতকালের জন্য খাবার জমিয়ে রাখে, আমিও তেমন চাকরি করে টাকা জমাই। গান করি। টাকা ফুরিয়ে গেলে আবার চাকরি করি। আবার ফিরে আসি গানে।’

একতারা ফোক গানের দল। তাঁরা লালন ফকির, সাধক রাধারমণ দত্ত, হাসন রাজার গান—মূলত এগুলোই গান। এ ছাড়া তাঁদের গাওয়া অসমিয়া গান ‘মনে করি আসাম যাব’ও আলোচিত হয়েছে ফেসবুক, ইউটিউবে। দিনা জানালেন, ইউটিউবে যাঁরা গানটির প্রশংসা করেছেন, তাঁদের মধ্যে একটা বড় অংশই ভারতের মেদিনীপুর আর আসামের মানুষ। এটা একতারার কাছে একটা বড় পাওয়া।

দেশীয় নানা বাদ্যযন্ত্র একতারার গানের অনুষঙ্গ, আছে ডুককি, খোল, সরোদ, বাঁশি। মেলা থেকে একটা পাখির মতো দেখতে বাঁশি কিনেছিলেন। সেটার ভেতর পানি ভরে ফুঁ দিলে সুন্দর আওয়াজ হয়। এই পাখিকেও গানের অনুষঙ্গ করেছেন তাঁরা। এত সব বাদ্য বাজানো শিখলেন কী করে? উত্তর দিতে গিয়ে আজমাইন শোনালেন এক অদ্ভুত তত্ত্ব, ‘আপনি যদি কোনো যন্ত্র বাজাতে চান, আগে তিন মাস সেটা সঙ্গে নিয়ে ঘুমাবেন। কীভাবে শিখতে হবে, কোথায় শেখা যায়, দেখবেন আস্তে আস্তে সব আপনার জানা হয়ে যাবে।’

সব শেষে জানতে চাইলাম, গান করে তাঁদের সবচেয়ে বড় অর্জন কী? উত্তর এল, গানই নাকি তাঁদের বাঁচিয়ে রেখেছে। গানের ভেতর দিয়েই তাঁরা নিজেদের অস্তিত্ব অনুভব করেন, প্রতিনিয়ত ভালো মানুষ হওয়ার তাগিদ বোধ করেন।

একতারার সদস্যরা জানেন, ভাইরালের এই যুগে ভাইরাল হওয়া যত সহজ, টিকে থাকা ততটাই কঠিন। কঠিন কাজটাই তাঁরা করতে চান, একসঙ্গে যেতে চান অনেক দূর।