পাবলিক পলিসি অ্যান্ড লিডারশিপ নিয়ে ভিন্নধারার মাস্টার্স প্রোগ্রাম

চট্টগ্রামের ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি
চট্টগ্রামের ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি

একবিংশ শতকে আছি আমরা। বর্তমানের নিরিখে দিন দিন অচল হয়ে পড়ছে পুরোনো জ্ঞান, চিন্তাধারা। বদলেছে প্রতিষ্ঠান, কাজের ধরন ও কর্মকৌশল। যার প্রভাব পড়েছে জীবনের সর্বক্ষেত্রে। সুশাসন ও নেতৃত্বের মতো বিষয় গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সর্বত্র। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে নতুন এক মাস্টার্স প্রোগ্রাম, পাবলিক পলিসি অ্যান্ড লিডারশিপ। বাংলাদেশে না হলেও উন্নত বিশ্বে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে এটি বর্তমানের একটি বহুল পঠিত বিষয়। বাংলাদেশেও চালু হয়েছে প্রোগ্রামটি। চট্টগ্রামের ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটিতে গবেষণানির্ভর এ মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি চলছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন এ প্রোগ্রাম সম্পর্কে পাঠকদের জানাতে এই প্রতিবেদন।

পাবলিক পলিসি কী?
পাবলিক পলিসি বা জননীতি হলো প্রশাসনিক কর্ম সম্পাদনে সরকার বা রাষ্ট্রের আদর্শিক অবস্থান। সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত, যা জনগণের বৃহৎ কল্যাণ ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে প্রণয়ন করা হয়, তাই পাবলিক পলিসি। কিন্তু বর্তমানে পাবলিক পলিসি শুধু সরকারের নৈতিক অবস্থানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এটি একই সঙ্গে করপোরেট বিশ্ব থেকে শুরু করে জনসম্পৃক্ত প্রতিটি ক্ষেত্রকেই সংযুক্ত করেছে।

কেন পাবলিক পলিসি গুরুত্বপূর্ণ?
নীতিনির্ধারণের এ ক্ষেত্র নাগরিক জীবনের প্রায় প্রতিটি পর্যায়কে প্রভাবিত; বলা ভালো, নিয়ন্ত্রণ করে। জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক, জনগণের মনোভাব, জনকল্যাণ, রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক সমস্যার সমাধান, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ প্রভৃতি বিষয় নির্ভর করে সরকারের গৃহীত নীতির ওপর। এর বাইরেও বেসরকারি বা বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো তাদের সাফল্যের জন্য যে বাণিজ্য নীতিমালা গ্রহণ করে, তাও সমাজে প্রভাব ফেলে, প্রভাব রাখে সামাজিক পরিবর্তনেও। ফলে ক্ষেত্রটি গুরুত্বপূর্ণ তো ছিলই, ক্রমান্বয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

চট্টগ্রামের ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি
চট্টগ্রামের ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি

পাবলিক পলিসির সঙ্গে কেন যুক্ত হলো লিডারশিপ বা নেতৃত্ব?
বিশ্বায়ন ও ডিজিটালাইজেশনের এ যুগে সবকিছুই খুব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, পত্তন ঘটেছে ডিজিটাল গভর্ন্যান্সের। এ ই-গভর্ন্যান্স একাধারে জটিল ও বহুমুখী। তাই সমসাময়িক সমস্যা মোকাবিলায় প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আধুনিক ও যুগোপযোগী অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ জ্ঞান। জরুরি হয়ে পড়েছে সংস্কার ও আধুনিকায়ন। গবেষকেরা বলছেন, এ পরিবর্তন আনতে প্রয়োজন দক্ষ ও বহুমাত্রিক নেতৃত্ব।

গ্রিক দার্শনিক প্লেটো যে ‘ফিলসফার কিং’ বা দার্শনিক রাজার কথা বলেছিলেন, তার মূল কথাই ছিল জ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞই পারে নেতৃত্ব দিতে। বিষয়টি বৃহদার্থে রাজনীতি ও সরকারি ক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও প্রাইভেট সেক্টরেও এর গুরুত্ব কম নয়। এমনকি গণতান্ত্রিক রাজনীতিতেও বর্তমানে ব্যক্তির যে প্রভাব, তা থেকে বলা যায়, পলিসি নির্ধারণে ব্যক্তির ভূমিকাকে গৌণ করে দেখার সুযোগ নেই। ব্যক্তিই প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা গড়ে তোলে। তাই ব্যক্তিকে গড়ে তোলা জরুরি।

কেন ইডিইউর এই মাস্টার্স প্রোগ্রাম?
সমাজের নানা পর্যায়ে নীতিনির্ধারণে বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এ প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে। ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি (ইডিইউ) পাবলিক পলিসির সঙ্গে লিডারশিপকেও যুক্ত করেছে, যা বাংলাদেশে প্রথম বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান সাঈদ আল নোমান।

সাঈদ আল নোমান বলেন, বর্তমান দেশীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সমাজে ও প্রতিষ্ঠানে মৌলিক প্রভাব রাখতে আগ্রহীদের জন্য চট্টগ্রামে ইস্ট ডেল্টাই প্রথম এ ধরনের গবেষণানির্ভর বিশেষায়িত মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু করেছে, যেখানে নীতিনির্ধারণ সম্পর্কিত জ্ঞানের সঙ্গে নেতৃত্ব সৃষ্টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নৈতিক নেতৃত্ব বা এথিক্যাল লিডারশিপের গুরুত্ব অনুধাবন করে নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো ক্রমবিকাশের লক্ষ্যে সাজানো হয়েছে এ মাস্টার্সের কারিকুলাম।

ক্যারিয়ারে কীভাবে সহায়তা করবে এই মাস্টার্স?
উপরিউক্ত পয়েন্টগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে পাবলিক পলিসি অ্যান্ড লিডারশিপ মাস্টার্সকারীরা সরকারি সংস্থা, সেবাদানকারী ও উন্নয়ন সংস্থা এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন। এ ছাড়া যাবতীয় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, একাডেমিক সেক্টরসহ বৃহৎ পরিসরে কর্মোপযোগী করে গড়ে তুলতে এ প্রোগ্রামের কোর্স মডিউল তৈরি করেছে ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি।

বেসরকারি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর হবে এই মাস্টার্স?
নিউজ ও সোশ্যাল পলিসি বিষয়ে আমেরিকার র‌্যাঙ্কিংয়ে প্রথম স্থান অধিকারী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল ২০১৪ সালে পাবলিক পলিসির স্নাতকোত্তরদের কর্মস্থান পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, পাবলিক পলিসি নিয়ে মাস্টার্স সম্পন্নকারীদের দুই–তৃতীয়াংশ সরকারি ও অলাভজনক সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলেও বাকি একাংশ কর্মরত আছেন বেসরকারি বাণিজ্যিক বা লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এর কারণ হিসেবে তারা তিনটি বিশেষত্ব খুঁজে পেয়েছে—

প্রথমত, এই মাস্টার্স প্রোগ্রাম শিক্ষার্থীদের মেধা ও ব্যক্তিত্ব তথা পার্সোনালিটিকে শাণিত করে, ফলে কর্মস্থলে মৌলিক ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারে।

দ্বিতীয়ত, বাস্তবভিত্তিক কোর্সওয়ার্ক ও অভিজ্ঞতা অর্জন হয়, ফলে নীতি-কৌশল নির্ধারণ এবং জনমানসিকতা নিরূপণ ও পরিবর্তনে সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

তৃতীয়ত, টিমওয়ার্কের চর্চা ও মনোভাব তৈরি হয়। ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায় তারা টিমের অভ্যন্তরে ব্যক্তিগত প্রভাব সৃষ্টি ও নেতৃত্ব দানে সক্ষম হয়ে ওঠে।

বর্তমান সময়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহে যে ধরনের নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন, তার সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রনীতির একধরনের মিথস্ক্রিয়া এই মাস্টার্স প্রোগ্রামের বৈশিষ্ট্য। বাণিজ্যিক ও প্রাইভেট হলেও এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কাজও মূলত রাষ্ট্র ও নাগরিকদের সঙ্গেই, ফলে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা সম্পর্কে জানা না থাকলে প্রতিষ্ঠানের নীতি-কৌশলও নির্ধারণ সম্ভব হবে না, নেতৃত্বের সক্ষমতাও বিকশিত হবে না। তাই রাষ্ট্র ও সরকার–সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদেরও সমকালীন প্রেক্ষাপটে নিজেকে আধুনিক করে তুলতে হলে পাবলিক পলিসির বিশেষজ্ঞতা অর্জন জরুরি।

কী কী পড়ানো হবে এ প্রোগ্রামে?
অক্সফোর্ড-হার্ভার্ড-ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটি ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের কারিকুলামের আদলে বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতা ও জনমানসিকতাকে মাথায় রেখে এ প্রোগ্রাম সাজানো হয়েছে। পাবলিক পলিসি নিয়ে প্রাক্-বিশ্লেষণ, পলিসি নির্ধারণ, প্রয়োগ, পুনঃবিশ্লেষণ ও বাস্তবভিত্তিক মূল্যায়ন এবং একই সঙ্গে নেতৃত্বের উন্মেষ ঘটাতে প্রোগ্রামটিতে একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, ব্যবসায় প্রশাসন, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক আইন, উদ্যোক্তা, লোকপ্রশাসন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ব্যবস্থাপনা, পরিসংখ্যান, দর্শনের মতো বিষয়কে একীভূত করে সাজানো হয়েছে। একই সঙ্গে রিসার্চ মেথডোলজি, যৌক্তিক বিশ্লেষণ এবং ডেটা বিশ্লেষণও বিশদভাবে যুক্ত করা হয়েছে এই কারিকুলামে।

ইডিইউ প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধাসমূহ কী কী
সামার সেমিস্টার থেকে স্কুল অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অধীনে প্রোগ্রামটি শুরু হয়েছে। তিন পদ্ধতিতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করা যাচ্ছে। এগুলো হলো রিসার্চ মোড (Research Mode), রিসার্চ ও কোর্সওয়ার্কের সমন্বিত মোড এবং শুধু কোর্সওয়ার্ক বা টট মোড (Taught Mode)।

নতুন চালু হওয়া এ প্রোগ্রামে শিক্ষার্থীদের জন্য ‘শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড’–এরও ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এতে টিউশন ফিতে দেওয়া হচ্ছে ৭০ শতাংশ ছাড়। শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের নামে এই স্কলারশিপের নামকরণের বিষয়ে সাঈদ আল নোমান বলেন, ‘অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী, বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী এবং পরবর্তী সময়ে গভর্নর হিসেবে বাংলায় শিক্ষাবিস্তার, রাজনৈতিক অধিকার ও সচেতনতা তৈরিতে তাঁর নেতৃত্ব এবং অবদানকে স্মরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাঁর কর্মের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে এ নামকরণ।’

এ ছাড়া ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে অনুপ্রেরণা ও প্রেষণা দিতে ইডিইউ ঘোষণা দিয়েছে চেয়ারম্যানস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ডের। এতে টিউশন ফিতে শতভাগ ছাড় দেওয়া হচ্ছে।

কাদের জন্য এই মাস্টার্স?
ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির এই মাস্টার্স প্রোগ্রামে যেকোনো ক্ষেত্রে কর্মরতদের বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম করে তুলতে জোর দেওয়া হচ্ছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্র ও সরকার–সংশ্লিষ্ট, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তি, আইনজীবী, পরামর্শকের মতো স্ব-অনুশীলনকারীরাও এতে অংশ নিতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে প্রার্থীদের অবশ্যই ¯œস্নাতকধারী হতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক নীতিনির্ধারণ ও নেতৃত্বমূলক কাজের ন্যূনতম এক বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে। এ ছাড়া চেয়ারম্যানস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড পেতে হলে প্রার্থীর পাঁচ বছরের প্রাতিষ্ঠানিক কাজের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সমাজের যেকোনো পর্যায়ে গুণগত পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে; এবং আইইএলটিএসে গ্র্যান্ডস্কোর ৭ বা ন্যূনতম ১টি গবেষণামূলক প্রকাশনা থাকতে হবে।

এই প্রোগ্রামে পড়ানো ও তত্ত্বাবধানে কারা থাকছেন?
এ প্রোগ্রামে আমেরিকার সেন্ট্রাল মিশিগান ইউনিভার্সিটি, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব মালয়েশিয়ার (আইআইইউএম) পাবলিক পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব শারজাহ, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির পিএইচডি ডিগ্রিধারী গবেষণায় অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রফেসররা ফ্যাকাল্টি লিডারশিপে থাকবেন।