বাংলাদেশের টিম পেন্টাকোয়ার্ক পেল বিশেষ সম্মাননা

বাঁ থেকে সাদমান, রায়হান, হাসিব, সাদ, রাফাহ ও ওমর। ছবি: খালেদ সরকার
বাঁ থেকে সাদমান, রায়হান, হাসিব, সাদ, রাফাহ ও ওমর। ছবি: খালেদ সরকার

‘আমরা মাথায় মাথায় গবেষণা করি,’ শুনে রীতিমতো চমকে উঠেছিলাম। বলে কী এসব? গবেষণাগার ছেড়ে এবার নাকি মাথায় চলবে বিজ্ঞানের কারিকুরি! সামনে বসা শিক্ষার্থীরা বুঝিয়ে বলে—কোনো গবেষণা চাইলেই হঠাৎ করে শুরু করা যায় না। এর জন্য চাই সঠিক পরিকল্পনা, ব্যাকগ্রাউন্ড রিসার্চ আর শেষ পর্যন্ত লেগে থাকার মনোবল। প্রথম দুটোর পুরোটাই সারতে হয় খাতা-কলমে, কম্পিউটারের জটিল হিসাব থেকে আর মাথা খাটিয়ে। 

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ১৬ থেকে ২০ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য ইউরোপিয়ান কণা গবেষণাকেন্দ্র সার্ন ও জার্মানির গবেষণা ইনস্টিটিউট—ডেসি যৌথভাবে আয়োজন করে ‘বিমলাইন ফর স্কুল’ প্রতিযোগিতা। সংক্ষেপে বিএলফোরএস। ষষ্ঠবারের মতো বিমলাইন ফর স্কুল শুরু হয় এ বছর। কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেও খুব একটা ভালো ফল পায়নি। তবে এ বছরই বিশেষ সম্মাননা দলের কাতারে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। ‘টিম পেন্টাকোয়ার্ক’ নামে বাংলাদেশের হয়ে এই আয়োজনে অংশ নেয় ঢাকার নটর ডেম কলেজের জুলিয়ান রাফাহ, সাদ বিন কুদ্দুছ, ওমর সাঈদ, হাসিবুল হাসান ও রায়হান আমিন। ওরা সবাই এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ছাড়া ওদের মেন্টর হিসেবে সাহায্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আরশাদ মোমেন। সম্প্রতি প্রথম আলো কার্যালয়ে এসেছিল এই খুদে গবেষকদের দল। 

পৃথিবীর নানা দেশের পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণায় আগ্রহী শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে তাদের পরিকল্পিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা জানিয়ে আবেদন করে বিএলফোরএসে। সঙ্গে পাঠাতে হয় এ বিষয়ে ১ মিনিটের একটি ভিডিও। কণা, তরঙ্গ কিংবা পদার্থবিজ্ঞানের কোনো উদ্ভাবনী গবেষণার কথা জানিয়ে আবেদন করা যায় এই প্রতিযোগিতায়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গবেষণার পরিকল্পনা প্রস্তাব আকারে জমা দিতে হয়। সেখান থেকে বাছাইকৃত সেরা ২০টি দলের ভেতরে প্রথম দুটি দল বিশ্বের সেরা এই গবেষণাগারে নিজেদের প্রস্তাবিত পরীক্ষাগুলো নিজ হাতে করে দেখার সুযোগ পায়, তাদের সাহায্য করেন বিশ্বসেরা গবেষকেরা। অন্যদিকে বাকি দলগুলোর প্রত্যেকটির জন্য উপহার হিসেবে থাকে কসমিক-পাই রে ডিটেক্টর। যা দিয়ে শিক্ষার্থীরা কসমিক–রে এর গতি-প্রকৃতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারে। এ ছাড়া বিশেষ সম্মাননা হিসেবে পরবর্তী ১০টি দলের জন্য থাকে সার্টিফিকেট ও সার্নের অফিশিয়াল টি–শার্ট। 

এ বছরের বিমলাইন ফর স্কুল আয়োজনে বিশ্বের ৪৯টি দেশের ১৭৮টি দল আবেদন করে। ২০১৪ সাল থেকে শুরু হওয়া এই আয়োজনে এ পর্যন্ত জমা পড়েছে ৮৪টি দেশের ১১১৪টি দলের গবেষণা প্রস্তাব। বাছাই শেষে এ বছর সেরার সম্মাননা পায় নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্রের দুটি দল। যারা আগামী অক্টোবর মাসে ডেসাইতে তাদের প্রস্তাবিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ পাবে। 

টিম পেন্টাকোয়ার্কের গবেষণা ছিল কী নিয়ে? শিক্ষার্থীরা বলল, কোনো নির্ধারিত লক্ষ্য অতিক্রমের সময় ইলেক্ট্রনা যে পরিমাণ শক্তি হারায় তা হিসাব করা যায় বেথে–ব্লখ্​ ও লানডাউ ফর্মুলা থেকে। আবার কণা বিক্ষেপণের ধর্মকে ব্যাখ্যা করার জন্য বিজ্ঞানীরা হিসাব কষেন হাইল্যান্ড ফর্মুলায়। এমন সব তাত্ত্বিক সমীকরণকে হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখার প্রস্তাবনাই তারা পাঠিয়েছিল বিমলাইন ফর স্কুল আয়োজনে। 

এ দলের পথচলা শুরু হয় জুলিয়ান রাফাহের হাত ধরে। তার সঙ্গে যোগ দেয় আরও ৫ বন্ধু। একটু একটু করে নিজেদের ঝালিয়ে নিয়ে একদিন সাহস করে সবাই মিলে দেখা করতে যায় অধ্যাপক আরশাদ মোমেনের সঙ্গে। কলেজপড়ুয়া একদল উৎসাহী কিশোরকে কাছে পেয়ে সাহায্য করতে মোটেও কার্পণ্য করেননি তিনি। কিছু মাথায় এলেই তখন সবাই মিলে ছুটত মেন্টরের কাছে। আরশাদ মোমেন বেশ যত্নের সঙ্গে বোঝাতেন গবেষণার বিষয়বস্তুগুলো। গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত এই আয়োজনে প্রস্তাব জমা দেওয়ার সময় ছিল। তবে গোটা দলটিই তৈরি হয় ডিসেম্বর মাসে। এত কম সময়ের পরিকল্পনায় ভুল থাকাই স্বাভাবিক। তার মাশুল হিসেবে প্রথম পাঁচটি প্রস্তাব নাকচ করে দেয় বিমলাইন ফর স্কুলের আয়োজকেরা। 

তবে হাল ছাড়েনি টিম পেন্টাকোয়ার্ক। দলকে অনুপ্রেরণা দিতে এবার সক্রিয় ভূমিকা রাখেন মেন্টর আরশাদ মোমেন। প্রস্তাবের নানা বিষয়বস্তু বদলে, সেগুলোতে সংশোধন করার পরামর্শ দেন তিনি। এবার দলের সবাই নিজেদের কাজ ভাগ করে নেয়। ওদের ভিডিও বানাতে সাহায্য করে সাদমান মাহমুদ। 

পদার্থবিজ্ঞানের জটিল সমস্যা সমাধানে সবাই অভ্যস্ত হলেও এ ধরনের আয়োজনে বাংলাদেশের দেখা মেলা ভার। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে কী করণীয় জানতে চাইলে রায়হান বলে, ‘আমাদের দেশে ভালো গবেষণাগার নেই বলে অনেকে হাল ছেড়ে দেয়। এটা নেই-ওটা নেই অজুহাতে এ ধরনের আয়োজনে এগোতে চায় না। কিন্তু আমরা এই আয়োজন থেকে শিখেছি যে নিজের সবচেয়ে কম রিসোর্স ব্যবহার করে কীভাবে গবেষণা করা যায়। তাত্ত্বিকভাবে আমরা যত কিছুই চিন্তা করি না কেন, পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানে সেসব প্রমাণ করার চেষ্টা এক নতুন অভিজ্ঞতা।’

আরশাদ মোমেন,অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরশাদ মোমেন,অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ছোটখাটো কর্মশালা আয়োজনের পরিকল্পনা আছে 

বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে পরীক্ষামূলক কণা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে তেমন কোনো বিস্তারিত আলোচনা না থাকলেও, আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা একটু একটু করে নিজেদের আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। যা আমাদের জন্য বেশ আনন্দের বিষয়। এ ধরনের নতুন বিষয় নিয়ে যদি আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরাও আগ্রহী হয়ে ওঠে তাহলে অচিরেই এ বিষয়ে ভালো করার সুযোগ রয়েছে। কণা পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই এই প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব। ভবিষ্যতে দেশে এই আয়োজন নিয়ে ছোটখাটো কর্মশালা করার পরিকল্পনা আছে আমার। সেসব জানতে শিক্ষার্থীরা চোখ রাখতে পারে বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের ফেসবুক পেজে (fb. com/BdPhO)। এ ছাড়া এই লিংকেও বিস্তারিত জানা যাবে বিমলাইন ফর স্কুল সম্পর্কে: beamlineforschools.cern। আমরা আশা করতেই পারি, ভবিষ্যতে বিশেষ সম্মাননার তালিকা থেকে সেরাদের মঞ্চে উঠে আসবে বাংলাদেশ দল।