নম্বর গণনায় প্রচুর ভুল

এসএসসি ও এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষায় উত্তরপত্রের নম্বর গণনাতেই অসংখ্য ভুল ধরা পড়ছে। উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ থাকলে ভুলের হিসাবটি আরও দীর্ঘ হতো বলে মনে করেন শিক্ষা বোর্ডগুলোর কর্মকর্তা, শিক্ষক, অভিভাবক ও পরীক্ষার্থীরা।

কেবল চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় সারা দেশে ৪ হাজার ৩১২ জন পরীক্ষার্থী নম্বর গণনায় ভুলের শিকার হয়, যা তাদের পুনর্নিরীক্ষণ আবেদনের পর সংশোধন হয়েছে। এর মধ্যে ৬৪৭ জন নতুন করে ফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ পেয়েছে। এমনকি ৬১৯ জন একেবারে অনুত্তীর্ণ থেকে উত্তীর্ণ হয়েছে।

১৭ জুলাই প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফল নিয়েও আপত্তি উঠেছে। কেবল ঢাকা বোর্ডের অধীনেই এই পরীক্ষায় ৫২ হাজার ৯০০ পরীক্ষার্থী উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করেছেন।

আবেদন করা পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষণ করে কেবল প্রাপ্ত নম্বরে যোগ-বিয়োগে ভুল আছে কি না, তা দেখা হয়। সন্দেহ-সংশয় থাকলেও সব শিক্ষার্থী শেষ পর্যন্ত খাতা পুনর্নিরীক্ষণের জন্য দৌড়ঝাঁপ বা টাকা খরচ করে না। সে ক্ষেত্রে ভুলের প্রতিকার সবাই যে পাচ্ছে, তাও নয়।

উত্তরপত্রের নম্বর যোগ-বিয়োগে ভুল অব্যাহত থাকায় পরীক্ষার্থী ও পরীক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ থাকলে বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থী প্রতিবছর ফেল থেকে পাস এবং পাস করাদের অনেকের গ্রেড পরিবর্তন হবে। যদিও বোর্ডের নিয়মে উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের সুযোগই নেই। আর সেই সুযোগ দেওয়ার দাবিতে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করা হয়েছে।

তিন বছরের ফল বিশ্লেষণ
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীনে তিন বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার পুনর্নিরীক্ষণের ফল সংগ্রহ ও সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভুলের সংখ্যা কমছে না।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় গত তিন বছর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে ৩ লাখ ১০ হাজার ৪৮৩ জন পরীক্ষার্থী উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষণের জন্য আবেদন করে। এর মধ্যে ৯ হাজার ৮৩১ জন পরীক্ষার্থীর ভুল সংশোধন ও ফল পরিবর্তন হয়েছে, যা আবেদনকারীদের ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ।

সংশোধিত ফল অনুযায়ী, ১ হাজার ১৮৭ জন পরীক্ষার্থী নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে। আর ১ হাজার ৩৯৯ জন পরীক্ষার্থী অনুত্তীর্ণ থেকে উত্তীর্ণ হয়েছে।

একেবারে অনুত্তীর্ণ থেকে উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষার্থীদের একজন জয়ন্ত বর্মণ। সে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। গত ৬ মে প্রকাশিত ফলে সে পাসই করেনি। এটা বিশ্বাস না হওয়ায় খাতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। ১ জুন পুনর্নিরীক্ষণের ফলে দেখা যায়, সে জিপিএ ৩ দশমিক ২৮ পেয়েছে।

কিন্তু আবেদন করলেই যে সবার ফল পরিবর্তন হয়, তা নয়। রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নাফিস সাদিক ভূঁইয়া ও ইসমাইল খানের মতো ১৪ জন শিক্ষার্থী এবার তাদের এসএসসির ফল পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করেও সুফল পায়নি। বিদ্যালয়ে খুব ভালো ফল করা ইংরেজি ভার্সনের এসব শিক্ষার্থীর প্রায় সবাই ইংরেজি প্রথম পত্রে ৬০-এর কাছাকাছি নম্বর পেয়েছে, যা তাদের কাছে অবিশ্বাস্য। আবার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রসহ অন্য সব বিষয়েই তারা ৯০-এর কাছাকাছি নম্বর পেয়েছে।

নাফিস ও ইসমাইল প্রথম আলোকে বলেছে, ‘ভেবেছিলাম, গণনার ভুলে হয়তো এমন হয়েছে। কিন্তু একসঙ্গে পরীক্ষা দেওয়া ২৮ জনের ক্ষেত্রেই ইংরেজি প্রথম পত্রে এমন ফল আমরা মেনে নিতে পারছি না।’ উচ্চশিক্ষায় ভর্তি বা অন্য ক্ষেত্রে এই একটি বিষয়ের ফল বড় প্রভাব ফেলবে। তারা উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়ন চায়, কিন্তু বোর্ড আইনে সেই সুযোগ নেই।

ইসমাইল খানের শিক্ষক বাবা প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিকার চেয়ে তাঁরা উচ্চ আদালতে রিট করেছিলেন। আদালত ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে বিষয়টি স্বাধীনভাবে দেখার নির্দেশ দেন। তবে এখনো প্রতিকার পাননি।

শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের কমিটি আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাবকমিটির সভাপতির দায়িত্বে আছেন ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক। তিনি সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষকদেরও উত্তরপত্র মূল্যায়নে স্বাধীনতা থাকতে হয়। তবে ভুলভ্রান্তি যাতে না হয়, সে জন্যই পরীক্ষকদের বিপরীতে প্রধান পরীক্ষক ও নিরীক্ষকদের রাখা হয়। এরপরও যাতে পরীক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য পুনর্নিরীক্ষণের সুযোগ আছে। তাঁর দাবি, ভুলভ্রান্তি আগের চেয়ে কমছে। তবে খাতা পুনর্মূল্যায়ন চাইলে আইন সংশোধন করতে হবে।

পরীক্ষকের ঘাটতি, তাড়াহুড়ো
শিক্ষা বোর্ডগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, এখন প্রতিবছরই পরীক্ষার্থী বাড়ছে। লাখ লাখ উত্তরপত্র দেখার মতো মানসম্মত পরীক্ষকের যেমন ঘাটতি আছে, তেমনি ১৫ দিনের মধ্যে উত্তরপত্র মূল্যায়নের তাড়াহুড়ো থাকে। ফলে ভুলভ্রান্তি বাড়ছে, যথাযথ মূল্যায়ন নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। আর এসবের মাশুল গুনছে শিক্ষার্থীরা।  

পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ তিনটি শিক্ষা বোর্ডের পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপচারিতায় বেরিয়ে আসে, উত্তরপত্র দেখায় পরীক্ষকদের অনেকেই গাফিলতি করেন। প্রতিবছর হাজারো পরীক্ষার্থীকে এ জন্য খেসারত দিতে হয়। এর মধ্যে অনেকে পুনর্নিরীক্ষণ করে প্রত্যাশিত ফল পায়, অনেকের কষ্ট থেকে যায় জীবনভর।

যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আমিরুল আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, উত্তরপত্র মূল্যায়নে ভুলভ্রান্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাঁর মতে, মূলত দুটি কারণে উত্তরপত্র মূল্যায়নে বেশি ভুলভ্রান্তি হয়। প্রথমত, পরীক্ষক ও নিরীক্ষকদের গাফিলতি। দ্বিতীয়ত, উত্তরপত্র মূল্যায়নে যে সময় দেওয়া হয় সেটা পর্যাপ্ত নয়। তাড়াহুড়োর কারণে অনেক সময় পরীক্ষকেরা অন্যের সহায়তায় উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন বলে শোনা যায়।

বর্তমানে আটটি সাধারণ এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে সারা দেশে ১০টি শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষা হয়। নবগঠিত ময়মনসিংহ বোর্ডে এখনো পরীক্ষা শুরু হয়নি। পরীক্ষার পর কেন্দ্র থেকে উত্তরপত্রগুলো সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডে যায়। সেখান থেকে দেওয়া হয় নির্ধারিত পরীক্ষকদের কাছে। একেকজন পরীক্ষক গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন। একেকটি উত্তরপত্রের জন্য জেএসসিতে ১৫ টাকা, এসএসসিতে ২৫ টাকা ও এইচএসসিতে ৩০ টাকা সম্মানী দেওয়া হয়।

গড়ে সাত থেকে আটজন বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষকের বিপরীতে একজন প্রধান পরীক্ষক থাকেন। তাঁর অধীনে আবার দুজন নিরীক্ষক (শিক্ষক) থাকেন। পরীক্ষকেরা উত্তরপত্রগুলো মূল্যায়ন করে নির্ধারিত শিটে (ওএমআর শিট) নম্বর দিয়ে প্রধান পরীক্ষকের কাছে পাঠান। নম্বর যোগ-বিয়োগ সঠিক হয়েছে কি না, তা নিরীক্ষকেরা দেখেন। আবার প্রধান পরীক্ষকের দায়িত্ব তাঁর অধীন মূল্যায়ন হওয়া উত্তরপত্রের ১২ শতাংশ নিজে পুনরায় দেখা। যদিও অভিযোগ আছে, এই কাজগুলো প্রায় সময়ই ঠিকমতো হয় না।

এখন পরীক্ষা শেষ হওয়ার দুই মাসের মধ্যে ফল প্রকাশ হয়। এ জন্য পরীক্ষকদের বড়জোর ১৫ দিনের মধ্যে উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য সময় দেওয়া হয়।

রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুজন শিক্ষক এবং একাধিক শিক্ষা বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ দিনের মধ্যে একজন পরীক্ষকের পক্ষে ২৫০ থেকে ৩০০ উত্তরপত্র ভালোভাবে মূল্যায়ন করা কঠিন। কারণ, তাঁকে ক্লাস বা পরীক্ষা নেওয়াসহ আরও কাজ করতে হয়।

এবার এসএসসিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষার্থী ছিল ৫ লাখ ৪৮ হাজার ২২০, তাদের উত্তরপত্র ছিল প্রায় ৬০ লাখ। এসব উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেছেন প্রায় ১৫ হাজার পরীক্ষক।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, উত্তরপত্র মূল্যায়নে পরীক্ষকদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। আর কাকে পরীক্ষক করা হচ্ছে, সে বিষয়টিতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

দাবি খাতা পুনরায় মূল্যায়নের
অভিভাবক, শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষক ও শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা মিলিয়ে অন্তত ১৫ জনের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা বলেছেন, শুধু পুনর্নিরীক্ষণে কেবল মোটাদাগে উত্তরপত্রে প্রাপ্ত নম্বরের যোগ-বিয়োগে কোনো ভুল আছে কি না, তা দেখা হয়। তাও নির্ধারিত ফি দিয়ে আবেদন করলে। কোনো পরীক্ষক যদি একটি প্রশ্নের সঠিক উত্তরে শূন্য নম্বরও দিয়ে রাখেন, তাহলেও সেটি পুনরায় মূল্যায়ন করার সুযোগ নেই।

১৭ জুলাই এইচএসসির ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি পুনর্নিরীক্ষণে ফল পরিবর্তনের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ভুল কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভুল যেন একেবারেই না হয়, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে এই মুহূর্তে আইন সংশোধনের সুযোগ নেই বলে জানান মন্ত্রী।

শিক্ষা বোর্ডগুলোর একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিদ্যমান আইনানুযায়ী উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের সুযোগই নেই। কেবল ফল প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে শুধু উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করা যায়। পুনর্মূল্যায়নের বিধান না থাকা নিয়ে রিট হলে গত ২৩ মে হাইকোর্ট এ বিষয়ে রুল দিয়েছেন। ওই মামলায় আইনজীবীদের একজন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ভুল মূল্যায়নের কারণে পরীক্ষার্থীরা যাতে কোনোভাবেই বৈষম্যের শিকার না হয়, সে জন্যই পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ থাকা উচিত। এ জন্য বিদ্যমান আইনটি সংশোধন করা দরকার।