যন্ত্র ও বাদ্যযন্ত্র যাঁর সঙ্গী

মো. মেহেদী হাসান
মো. মেহেদী হাসান

‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলে চান্স পাওয়ার পর আম্মু-আব্বু বলল, “যা চাও তা–ই পাবে।” দোকানে একটা রোবট দেখে চোখ আটকে গেল। সেইটাই চাইলাম। পেলামও বটে। তখন থেকেই রোবট নিয়ে আগ্রহ ছিল অনেক। কেমন আমাদের মতো না হেঁটে, পা ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যেত রোবটটা। তবে এখন বুঝি, রোবটকে মানুষের মতো হাঁটানো চাট্টিখানি কথা নয়!’

কথা হচ্ছিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. মেহেদী হাসানের সঙ্গে। রোবট ছিল তাঁর নেশা। কিন্তু ভাগ্যে জুটল স্থাপত্য নিয়ে পড়াশোনা। স্থাপত্যের স্টুডিও বা ডিজাইনে তাঁকে খুব একটা পাওয়া না গেলেও, পাওয়া যেত ক্যাম্পাসের রোবোসাস্ট ল্যাবে। ল্যাবের সুপার কম্পিউটারটাই যেন ছিল তাঁর সব আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবেই সুযোগ ছিল দ্বিতীয় কোনো বিষয়ে পড়াশোনার। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন মেহেদী। দ্বিতীয় বর্ষেই কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে দ্বিতীয় মেজর শুরু করেন। বিশেষ করে প্রোগ্রামিং শেখার ঝোঁকই ছিল বেশি। তত দিনে স্থাপত্যের শিক্ষার্থী হিসেবে রোবটের ডিজাইন, কাঠামোটা বুঝলেও পিছিয়ে ছিলেন কোডিংয়ে। একসময় তা–ও পুষিয়ে নিলেন। তারই প্রমাণস্বরূপ জিতে নিলেন আইইউটি আয়োজিত ‘এসোনেন্স রবোম্যানিয়ার’ প্রথম রানারআপ পুরস্কার। এরপরই দেশের প্রথম বাংলায় কথা বলা হিউম্যানয়েড রোবটে কাজ করার সুযোগ পান। যার উদ্বোধন হয়েছিল ঢাকার কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে।

পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৬ সালে মেহেদী নতুন দল তৈরি করলেন। যার নাম দিলেন সাস্ট প্লাস প্লাস। এই দলের একেকজন ছিলেন একেক বিষয়ে পারদর্শী। চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত আরএমএ রোবরেস কম্পিটিশনে সাস্ট প্লাস প্লাস হলো চ্যাম্পিয়ন। তার মাসখানেক পরেই মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি আয়োজিত রোবলিউশনে রূপকদের দল দুটি রোবট নিয়ে হাজির। দুটোতেই বাগিয়ে নিল প্রথম ও দ্বিতীয় রানারআপের পুরস্কার। সে বছরেই নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি আয়োজন করে টেকনোভানজা, যা ছিল বাংলাদেশের প্রথম সুমোবট ফাইট। এতেও অপ্রতিরোধ্য সাস্ট প্লাস প্লাসই চ্যাম্পিয়ন হয়।

এদিকে প্রথম কথা বলা রোবটের কর্মযজ্ঞে যুক্ত থাকার সুবাদে মেহেদী পেয়েছিলেন ১০ লাখ টাকা সরকারি অনুদান। সেই অনুদান, অক্লান্ত পরিশ্রম আর আগ্রহে ভর করে এ বছর তিনি ও তাঁর দল এমন এক রোবট ডিজাইন করেন, যা রীতিমতো সফলভাবে হাঁটতে পারে! অনেক বাছবিচারের পর যার নাম ঠিক হয় ‘লি’। এই প্রকল্পে সুপারভাইজারদের একজন ছিলেন লেখক ও অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

শুধু রোবট বানিয়েই নয়, স্থাপত্যের শিক্ষার্থী হয়েই রোবটিকসের ওপর একাধিক কনফারেন্স পেপার লিখে ফেলেছেন মেহেদী। রোবটের নেশায় অবশ্য স্থাপত্যকে ভুলে যাননি তিনি। বরং স্থাপত্যই সাহায্য করেছে রোবটকে আরও নিঁখুত করায়। আর্গোনোমিকসের মতো স্থাপত্যের জটিল বিষয়ই সহজ করেছে রোবটের হাত, পায়ের মাপ বা চলার ভঙ্গি বুঝতে। স্থাপত্যের শিক্ষাই রোবটের কাঠামোগত দিক হোক বা মডেল তৈরি, সাহায্য করেছে সব ক্ষেত্রে। এদিকে ‘ক্ষেত্র’ নামে একটি স্থাপত্য ফার্মের হয়ে জাতীয় জাদুঘরের নকশা প্রতিযোগিতায় কাজ করেন মেহেদী। পরবর্তী সময়ে স্থপতি জালাল আহমেদের অধীনেও ‘মডেল মেকার’ হিসেবে কাজ করেন কেন্দ্রীয় কারাগার নকশা প্রতিযোগিতায়।

স্থাপত্য আর কম্পিউটার প্রকৌশলের মেলবন্ধনেই তিনি জিতে নিয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেভাল আর্কিটেকচার আয়োজিত মডেল শিপ প্রোপালশন প্রতিযোগিতা। স্থাপত্য শিক্ষা যেখানে সাহায্য করেছে নকশার ভাবনায়। অন্যদিকে কম্পিউটার প্রকৌশল সাহায্য করেছে তা কার্যকর করতে।

ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে তিনবারের চ্যাম্পিয়ন মেহেদীকে পুরো ক্যাম্পাস চেনে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা নামে। কারণ, তাঁর আরেক নেশা হলো বাঁশি। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই মায়ের কাছে গানের প্রথম হাতেখড়ি। গান আর বাঁশির সুর এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে শাবিপ্রবিতে মেহেদীকে চেনেন না, এমন মানুষ খুব কম! বাদ্যযন্ত্র নিয়েও নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেন। পাইপের বাঁশি, পকেট কাহন বা ছোট কি–বোর্ড বানিয়েছেন নিজেই।

রোবটের পায়ে ভর দিয়ে যেমন বিশ্বের কাছে নিজেকে জানান দিতে চান, ঠিক তেমনি যেন সুরের মূর্ছনায় সুন্দর এক পৃথিবীর স্বপ্নও দেখেন মেহেদী হাসান।

মো. মেহেদী হাসান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট