পড়া ও পেশার সুযোগ

মডেল: পিয়াস ও লিনা, কৃতজ্ঞতা: প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি, ছবি: খালেদ সরকার
মডেল: পিয়াস ও লিনা, কৃতজ্ঞতা: প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি, ছবি: খালেদ সরকার
আমাদের দেশের অর্থনীতির বড় একটি শক্তির জায়গা হলো বস্ত্র ও তৈরি পোশাকশিল্প। তরুণেরা কি এই খাতে পেশা গড়ার কথা ভাবছেন? কী কী সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে তাঁদের জন্য?

চিকিৎসক হব, প্রকৌশলী হব, গবেষণা করব, ব্যবসায়ী হব—এ রকম অনেক লক্ষ্যের কথা শুনি। কিন্তু ‘বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ে কাজ করব’—স্কুল-কলেজ পর্যায়ে এমনটা বোধ হয় খুব কম ছেলেমেয়েই ভাবে। অথচ আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি আর সম্ভাবনার জায়গাই হলো এই পোশাক খাত।

গোটা পৃথিবীতে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম মাস, অর্থাৎ গত জুলাইয়ে ৩৩১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ, সামনের দিনগুলোতে হয়তো আমরা আরও ভালো করতে পারব, যদি তরুণেরা চ্যালেঞ্জটা নেন।

আমাদের দেশে টেক্সটাইল বা তৈরি পোশাক–সংক্রান্ত পেশাগুলো নিয়ে নানা মতভেদ আছে। একদল বলবে টেক্সটাইলের চাকরি মানে দরজির কাজ, কেউ মনে করে টেক্সটাইলের চাকরি মানে গার্মেন্টসের সুইং অপারেটর কিংবা মার্চেন্ডাইজার হওয়া। আদতে কিন্তু এই খাতে চাকরি, গবেষণা বা উচ্চশিক্ষার পরিসরটা অনেক বড়, সুযোগও অনেক বেশি। কেন যেন আমরা এখনো জীবনের লক্ষ্য ঠিক করতে গিয়ে এই জায়গার কথা ভাবি না।

নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলি। আমি যখন স্কুলে পড়েছি, তখন চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছে ছিল। গণিত খুব ভালো লাগত বলেই হয়তো একসময় বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুটেক্স) জায়গা হলো। পরীক্ষার ফল ভালো হওয়ার পরও পোশাক প্রকৌশলে (অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং) স্নাতক পড়ার সময় পেশাজীবন নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় ছিলাম। কিন্তু স্নাতক কোর্স শেষ করার আগেই আমি এবং আমাদের ব্যাচের কয়েকজন বন্ধুর চাকরি হয়ে গিয়েছিল হংকংভিত্তিক একটি পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে। তারা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ‘জব ফেয়ার’ করেছিল, সেখানেই চাকরি পেয়ে গিয়েছিলাম আমরা ৬ জন।

আমার যেহেতু শুরু থেকেই গবেষণা ও শিক্ষকতার দিকে ঝোঁক ছিল, তাই বছর দেড়েক চাকরি করে আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিই। পাশাপাশি বুটেক্সে অ্যাপারেলস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর করছি। আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলব, উচ্চমাধ্যমিক পেরোনো তরুণেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে পা বাড়ানোর আগে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাত–সংক্রান্ত পড়ালেখা এবং এ খাতে পেশার সুযোগগুলো সম্পর্কে একটু খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।

সুযোগ ও সম্ভাবনা
পোশাকশিল্পই হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কানাডায় আমরা আগে থেকেই রপ্তানি করতাম, এখন তার সঙ্গে চীন, ব্রাজিল, জাপান, রাশিয়া, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, ভারতও যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সংগঠনের (বিজিএমইএ) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে পাঁচ বছরে ১ হাজার ২৫০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু চালু হয়েছে নতুন ৩০০-৩৫০টি কারখানা। এর মধ্যে পরিবেশবান্ধব কারখানা ৮০টি। সব মিলিয়ে পোশাক কারখানার সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার চার শ।

পোশাক কারখানা ছাড়াও এই খাতে আরও নানা সুযোগ রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে বস্ত্র পরিদপ্তর, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন ইত্যাদি। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও কাজ করছেন অনেকে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজের ধরনের বৈচিত্র্য আরও বেশি। ফ্যাশন ডিজাইন, মার্চেন্ডাইজিং, বিপণন, উৎপাদন, মান, কাটিং, প্রিন্টিং, ডায়িং, নিটিং, উইভিং, স্পিনিং, ল্যাব টেস্টিং, ওয়াশিং—প্রতিটি ধাপেই দক্ষ জনবল প্রয়োজন। বায়িং হাউসগুলোতে প্রোডাকশন লিডার, কোয়ালিটি লিডার, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টে রয়েছে কাজের সুযোগ। নিজে উদ্যোক্তা হয়েও অনেক তরুণ এই খাতে অবদান রাখছেন।

অতএব, শুধু যে টেক্সটাইল প্রকৌশল বা ফ্যাশন ডিজাইনের মতো বিষয়গুলো পড়েই এই খাতে কাজ করা যাবে, তা নয়। বিবিএ, কম্পিউটার প্রকৌশল, অর্থনীতি, এমনকি পরিবেশ প্রকৌশলে পড়েও বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে কাজ করা যায়।

নানা ধরনের কাজের সুযোগ আছে বস্ত্র ও তৈরি পোশাকশিল্প খাতে। আগ্রহ অনুযায়ী বেছে নিতে হবে কাজের ক্ষেত্র। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে
নানা ধরনের কাজের সুযোগ আছে বস্ত্র ও তৈরি পোশাকশিল্প খাতে। আগ্রহ অনুযায়ী বেছে নিতে হবে কাজের ক্ষেত্র। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে

কোথায় পড়ব
বিশেষায়িতভাবে শুধু টেক্সটাইল শিক্ষার জন্য বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় একমাত্র সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে টেক্সটাইলে পড়ার সুযোগ আছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি। শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে ফ্যাশন ডিজাইন ও প্রকৌশল এবং পোশাক প্রস্তুত উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও প্রকৌশলে স্নাতক করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছয়টি সরকারি টেক্সটাইল কলেজ আছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন–নিয়ন্ত্রিত সরকারি–বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টেক্সটাইল বিষয়ে তত্ত্বীয় জ্ঞানের পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিংয়ের (কারখানায় প্রশিক্ষণ) সুযোগ আছে। তাই কারও যদি আগ্রহ থাকে, তিনি অবশ্যই শিখতে পারবেন। আর যিনি কাজ জানেন, তাঁর নিশ্চয়ই বেকার থাকার কোনো কারণ নেই।

বাংলাদেশ থেকে স্নাতক শেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সুইডেন, জার্মানি, চীনে অনেকে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন। গবেষণামূলক কাজের জন্য কেউ কেউ আংশিক, আবার অনেকে শতভাগ বৃত্তিও পাচ্ছেন। মেডিকেল টেক্সটাইল, জিও-টেক্সটাইল, ই-টেক্সটাইল, সাস্টেইনেবল টেক্সটাইল নিয়ে গবেষণার প্রচুর সম্ভাবনা আছে।

যেতে হবে আরও দূর
বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে কি শুধু ছেলেরা, নাকি নারীরাও পেশা গড়তে পারেন? ঘুরেফিরে এই প্রশ্ন আমি নিজেও বহুবার শুনেছি। শিক্ষকতা, গবেষণা, ফ্যাশন ডিজাইন, উৎপাদন, পরিকল্পনা, বিপণন, মার্চেন্ডাইজিংয়ে কিন্তু অনেক নারীও কাজ করছেন। তাই আমি বলব, মেয়েদের পিছিয়ে থাকার কোনো কারণ নেই।

পুরো খাতটির পরিসর এত বড় যে আমার মনে হয়, এখনো অনেক কিছুই অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। তরুণেরা যদি আগ্রহী হন, তাহলে একদিকে যেমন তাঁরা নিজেরা পেশাজীবনে সফল হতে পারবেন, তেমনি দেশও এগিয়ে যাবে। অপ্রিয় হলেও সত্য, বাংলাদেশের পোশাক খাতে প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় পদে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কাজ করছেন ভারতীয়, শ্রীলঙ্কান বা চীনারা। যাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার কারণেই এই জায়গা দখল করে নিয়েছেন। আমাদের তরুণেরা যদি উদ্যোগী হন, শিক্ষাজীবন থেকেই নিজেকে গড়ে তোলেন, তাহলে তাঁরা কেন পারবেন না?

লেখক: প্রভাষক, আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে
স্বপ্না ভৌমিক
কান্ট্রি ম্যানেজার, মার্ক্স অ্যান্ড স্পেনসার বাংলাদেশ
টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাকশিল্পে যদি তরুণেরা কাজ করতে আগ্রহী হন, আমি তাঁদের অবশ্যই স্বাগত জানাব। এখন তো এ–সংক্রান্ত বিষয়ে পড়ার জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। তবে বিশেষায়িত বিষয়ে পড়েই যে এই খাতে কাজ করতে হবে, তা নয়। যেকোনো বিষয়ে পড়েই কাজ করা যায়। আমার সঙ্গে এমন অনেকে আছেন, যাঁদের একাডেমিক শিক্ষায় তৈরি পোশাক খাত সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু তাঁদের যোগাযোগের দক্ষতা ভালো বলেই তাঁরা ভালো করছেন। এখন স্বল্পমেয়াদি অনেক কোর্স আছে। যেমন ধরুন, কীভাবে তুলা থেকে সুতা হয়, সুতা থেকে কাপড় হয়, এই জ্ঞান তাঁকে এগিয়ে রাখবে। অতএব যদি আগ্রহ থাকে, তাহলে যেকোনো বিষয়ে পড়লেও কিছু কোর্স করে নেওয়া ভালো। এ ছাড়া আমি মনে করি, এই খাতে কাজ করতে হলে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা থাকা জরুরি। কারণ, কারখানা বা উৎপাদননির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক ছোটাছুটি করতে হয়, পরিশ্রম করতে হয়। মূল কথা হলো, আগ্রহ আছে কি না। একটা সময় টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাকশিল্প খাতের বড় পদগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিদেশিরা কাজ করতেন। এখন কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড পুমার কান্ট্রি হেড হিসেবে বাংলাদেশে যিনি দায়িত্বে আছেন, তিনি কিন্তু বাংলাদেশি। অতএব উদাহরণ যেহেতু চোখের সামনেই আছে, তরুণেরা এই বড় পদগুলোর দিকে লক্ষ্য রেখে নিজেকে তৈরি করতেই পারেন।