ক্যাম্পাস অচলের অস্ত্র শাটল ট্রেন

শাটল ট্রেনের ইঞ্জিন চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন লোকোমাস্টার (চালক) খোরশেদ আলম। এমন সময় চার-পাঁচ তরুণ উঠে পড়েন ইঞ্জিনে। খোরশেদকে নিচে নামিয়ে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যান কদমতলী। সেখান থেকে অটোরিকশায় করে নিয়ে যাওয়া হয় পাঁচলাইশে। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যেই তরুণদের আরেকটি পক্ষ কেটে দেয় ট্রেনের ভ্যাকুয়াম হোসপাইপ।

১ সেপ্টেম্বরের এই ঘটনার মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠনগুলোর অবরোধের প্রথম শিকার হচ্ছে শাটল ট্রেন ও এর চালকেরা। আর এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় অচলের প্রধান ‘অস্ত্র’ হয়ে উঠেছে শাটল ট্রেন।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম অনেকটা শাটল ট্রেননির্ভর। ২৫ হাজার ৪৯৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬০ শতাংশই এ বাহনের ওপর নির্ভরশীল। দুটি শাটল ট্রেনে চড়ে তাঁরা নগর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া করেন। ফলে শাটল ট্রেন বন্ধ করে দিলে ক্যাম্পাস কার্যত অচল হয়ে পড়ে। তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, শাটল ট্রেনে হামলার বেশির ভাগ ঘটনা ঘটিয়েছেন ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা।

২৮ বছরে ৭০ বার হামলা

১৯৮০ সালের দিকে শাটল ট্রেনের যাত্রা শুরু। ১৯৯১ থেকে ২০১৯—এই ২৮ বছরে অন্তত ৭০ বার বিশ্ববিদ্যালয়গামী শাটল ট্রেনে হামলা চালিয়েছে ছাত্রসংগঠনগুলো। এসব হামলায় আহত হয়েছেন শতাধিক ট্রেনচালক ও তাঁদের সহকারীরা। পাশাপাশি শাটল ট্রেনের ২০ জনের বেশি চালক ও সহকারী ‘অপহরণের’ শিকার হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ট্রেনের সরঞ্জাম।

বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের তথ্য অনুযায়ী, চালকের ওপর হামলা চালিয়ে শাটল ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার প্রথম ঘটনা ঘটে ১৯৯১ সালের ৭ জুলাই। ওই দিন হাটহাজারীর চৌধুরী হাট এলাকা থেকে ট্রেনচালক এম এল দাশ ও তোফাজ্জল হোসেনকে তুলে নিয়ে যান ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা। এভাবে ২০০০ সাল পর্যন্ত শাটল ট্রেনের ওপর ১১টি হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে প্রতিবছর চার থেকে পাঁচবার করে শাটল ট্রেনের ওপর হামলা চালান বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। শাটল ট্রেনে সবচেয়ে বেশি হামলা ও অপহরণের ঘটনা ঘটে ২০০৮ সালে। এ সময় ছয়জন ট্রেনচালক ও সহকারী অপহরণের শিকার হন। ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তত ২৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।

বাস্তবায়িত হয় না সিদ্ধান্ত

২০১১ সালের ৭ এপ্রিল চালক ইদ্রিস মিয়া ও কামরুজ্জামান পাটোয়ারিকে বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে ব্যাপক মারধর করে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ ঘটনার পর ১৭ এপ্রিল রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় নয়টি সিদ্ধান্ত হয়। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল জড়িত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, শাটল ট্রেনে উপদেশমূলক পোস্টার সাঁটানো, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করে নিরাপদ ট্রেন চলাচল, ছাত্র ও রেল কর্মচারীদের নিরাপত্তা বিধান, উভয় পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া এবং হরতাল-অবরোধজাতীয় কর্মসূচির দিন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পূর্ব থেকে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা। তবে এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি।

গত মঙ্গলবার দুপুরে বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক–কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়িত হলে ট্রেনে হামলা ও চালকদের তুলে নেওয়ার ঘটনা কমত। তিনি বলেন, শাটল ট্রেনচালকদের ওপর হামলা ও অপহরণের ঘটনা ঘটলেও একটিরও বিচার হয়নি। এভাবে চলতে থাকলে চালকদের শাটল ট্রেন চালানো বন্ধ রাখা ছাড়া উপায় থাকবে না। গত রোববার ‘অপহরণের’ শিকার ট্রেনচালক খোরশেদ আলমকেও পাওয়া গেল ইউনিয়নের কার্যালয়ে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখনো আতঙ্কের মধ্যে আছেন।

কয়েক দিনের মধ্যেই এ বিষয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে জানিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর প্রণব মিত্র চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সেই বৈঠকে জড়িত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে সিদ্ধান্ত হবে।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ায় শাটল ট্রেনে বারবার হামলার ঘটনা ঘটছে বলে মন্তব্য করেছেন ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক। তিনি বলেন, যাঁরা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছেন, তাঁদের শাস্তি হলে এ রকম ঘটনা আর হবে না। বর্তমানে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য রয়েছে। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। তবে বামপন্থী কয়েকটি ছাত্র সংগঠন মাঝেমধ্যে কর্মসূচি পালন করে।

শাটল ট্রেন বারবার ছাত্রসংগঠনগুলোর নিশানা হওয়ায় ক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন বিভাগের পাঁচজন শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রসংগঠনগুলোর দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা। কিন্তু তারা প্রায় সময় শাটল ট্রেনে হামলা চালাচ্ছে।