দেখছি, পড়ছি, শিখছি

প্রিয় ক্যাম্পাসে ইউডার শিক্ষার্থীদের কয়েকজন। ছবি: খালেদর সরকার
প্রিয় ক্যাম্পাসে ইউডার শিক্ষার্থীদের কয়েকজন। ছবি: খালেদর সরকার

দিন পাঁচেক পর ক্লাসে ‘প্রেজেন্টেশন’ দিতে হবে। বিষয়—ইংরেজি সাহিত্য। তাই কাগজপত্র আর ল্যাপটপে বুঁদ হয়ে ছিলেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী পার্থ প্রতিম রায়, নুসরাত আলম, তাশজিনা ইয়াসমিন আর রিমন বড়ুয়ারা। ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ (ইউডা) বিশ্ববিদ্যালয়ের ধানমন্ডি ক্যাম্পাসে পা রাখলে শিক্ষার্থীদের এমন ছোট ছোট দলের সঙ্গে আপনার সব সময়ই দেখা হবে। কেউ পড়ালেখায় ব্যস্ত, কেউ আড্ডায় মশগুল। পার্থদের কাজে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে আমরা এগিয়ে যাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাব রুম আর স্পোর্টস জোনের দিকে।
সেখানে দেখা হলো আবির, ইশফাক, ইশতিয়াকদের সঙ্গে। কাগজের বোর্ড, ব্যানার, পোস্টার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তাঁরা। জানা গেল, সামনেই ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তারই প্রস্তুতি চলছে। শিক্ষার্থীদের একজন বললেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রীই বিভিন্ন ক্লাব কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। পরীক্ষা-পড়ালেখা তো থাকেই, এর মধ্যেই আমরা ক্লাবের কাজকর্মের মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসটা মাতিয়ে রাখি।’
২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন ৩৩০ জন শিক্ষক। ছয়টি অনুষদে চার বছর মেয়াদি স্নাতক ও দুই বছর মেয়াদি স্নাতকোত্তরে বিভিন্ন বিষয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে।

পড়াশোনায় যত বৈচিত্র্য
ক্যাম্পাস ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ কানে আসা গানের সুর আমাদের নিয়ে গেল কামরুজ্জামান রাব্বির কাছে। ম্যাজিক বাউলিয়ানা নামে একটি টিভি রিয়েলিটি শোতে অংশ নিয়ে এরই মধ্যে ক্যাম্পাসের তারকা বনে গেছেন তিনি। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। রাব্বি পড়ছেন সংগীত বিভাগে। তিনি বলেন, ‘আমরা যতটা না ক্লাসে পড়ি, তার চেয়ে বেশি শিখি হাতে-কলমে। সংগীতে পড়লেও প্রতিদিন তাত্ত্বিক সব ক্লাসে আমাদের অংশ নিতে হচ্ছে। শিক্ষকেরা ভীষণ কড়া! ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’ রাব্বির বন্ধুরা জানালেন, রিয়েলিটি শো চলাকালীন রীতিমতো ক্যাম্পাসে পোস্টার সাঁটিয়ে রাব্বির জন্য ভোট আদায় করেছেন তাঁরা। বোঝা গেল, ইউডাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটা পরিবার গড়ে উঠেছে।

আর্থিক প্রণোদনা ও এগিয়ে চলা
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যেমন মেধাভিত্তিক বৃত্তি লাভের সুযোগ আছে, তেমনি আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরাও বৃত্তি পেয়ে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান, প্রত্যন্ত এলাকার মেধাবী দরিদ্র শিক্ষার্থী এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ ভালো বৃত্তির সুযোগ আছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শিল্প-সাহিত্যের যেকোনো শাখায় পারদর্শিতা থাকলে বা খেলাধুলায় ভালো করলে এখানে শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পান।

ভাষা ও সংস্কৃতিতে বিশেষ গুরুত্ব
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ক্লাবের শিক্ষার্থী শাকিল বলছিলেন, ‘ইউডাতে শিক্ষার্থীদের যেমন মাতৃভাষা ও দেশ সম্পর্কে জানানো হচ্ছে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের প্রস্তুত করতে ইংরেজি ভাষার দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবের মাধ্যমে প্রথম বর্ষ থেকে ইংরেজিতে প্রেজেন্টেশন, ইন্টারভিউ, লেখালেখি শিখছেন শিক্ষার্থীরা। প্রতিবছর বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভাষাগত ও উপস্থাপনার বিভিন্ন পরীক্ষা থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইউডার ১০টি আবাসিক হোস্টেল আছে, যেখানে পৃথকভাবে শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে।

পড়তে পড়তে কাজ
বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ও প্রোগ্রামিং ক্লাবের সভাপতি শাকিল আহমেদ খান, ফারহান সাকিব, জাহিদ বিন কিবরিয়া, আয়হান ফারুক ও তোফায়েল আহমেদ—দেখা হলো তাঁদের সঙ্গে। প্রোগ্রামিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তাঁরা। একজন বললেন, ‘সামনে বেশ কয়েকটি হ্যাকাথন আছে। সে জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ভাষা নিয়ে আমাদের এখানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।’ নিয়মিত কুইজ, হ্যাকাথন, অলিম্পিয়াডের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের শেষ সেমিস্টারে শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষানবিশি করতে হচ্ছে। স্নাতকের শেষ বছরটিকে ইউডাতে ‘প্রফেশনাল ইয়ার’ বলা হয়। সে বছর ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়ার পাশাপাশি নানা প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, সেমিনারে অংশ নেন। শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

গবেষণায় গুরুত্ব
বিভিন্ন ল্যাবে শিক্ষার্থীদের জটলা চোখে পড়ল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া নুসরাত জানালেন, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের সব বিভাগেই গবেষণার দিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। শুধু জীববিজ্ঞান অনুষদে এ পর্যন্ত ৩৮৭টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণাগার আছে। প্রকৌশল অনুষদে আছে আধুনিক কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, ইলেকট্রনিকস, ডিজিটাল ইলেকট্রনিকস ও কমিউনিকেশন ল্যাব। ফার্মাসি বিভাগের জন্য আছে ফার্মাসি, মাইক্রোবায়োলজি, এনিমেল হাউস ও টিস্যু কালচার ল্যাব। কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের জন্য আছে ডিজিটাল স্টুডিও ও ল্যাব। আইন ও মানবাধিকার বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আছে মুট কোর্ট। কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ থেকে প্রতিবছর জার্নাল প্রকাশিত হচ্ছে নিয়মিত।

ইউডার প্রাক্তন ছাত্র এম নুরুন্নবী হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলে গবেষণা শেষ করে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে শিক্ষকতা করছেন। ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে কাটাছেঁড়া না করে সহজেই কীভাবে হার্টের ব্লক দূর করা যায়, সেটাই তাঁর গবেষণার বিষয়। আরেক প্রাক্তনী—বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম। তিনি ন্যানো টেকনোলজি ও জিন থেরাপি নিয়ে গবেষণা করছেন।

মেধাভিত্তিক সহনশীল প্রজন্ম তৈরির প্রচেষ্টা
অধ্যাপক মুজিব খান, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ
উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে তরুণদের জন্য শুধু একটি ক্যারিয়ার বা ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়া আমাদের লক্ষ্য নয়। আমরা সামাজিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে, তরুণ প্রজন্মকে সহনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আমরা যেমন ক্লাসের পড়াশোনাকে গুরুত্ব দিই, তেমনি সাংস্কৃতিক কাজে সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি। ভবিষ্যৎকে দারুণভাবে গড়তে হলে বর্তমানকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রতিটি মুহূর্ত যেন কাজে লাগে, সেদিকে আমরা শিক্ষকেরা খুবই সচেতন। ব্যক্তিমানুষ হিসেবে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যা শিখছে, তা তাঁদের জীবনে যেন কাজে লাগে, সেভাবেই সাজানো হয়েছে আমাদের পাঠ্যক্রম। নিয়মিত শিক্ষানবিশি, ক্লাসের বাইরে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাজে অংশগ্রহণ, সৃজনশীল কাজে যুক্ত হওয়া, নিয়মিত গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ ও গবেষণা করার মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীরা ইতিবাচক ও সহনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছে।