'আমরা আনিব রাঙা প্রভাত'

‘এই বটতলায় বসেই কাজী নজরুল ইসলাম বাঁশি বাজাতেন। কল্পনার খুব গভীরে ডুব দিলে যেন চোখে ভাসে, কিশোর বয়সী নজরুল এখানে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। তাই অবসর কাটানোর জন্য এই জায়গায় আমরা প্রায়ই বসি।’ গত সোমবার দুপুরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ঐতিহাসিক বটতলায় বসে কথাগুলো বলছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি সজীব আহমেদ।
ময়মনসিংহ শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ত্রিশাল উপজেলার নামাপাড়া গ্রামে ৪২ একর জমির ওপর অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৬ সালের ৯ মে প্রতিষ্ঠিত হয় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ক্লাস শুরু হয় ২০০৭ সালের ৩ জুন থেকে। মাত্র চারটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিধি দিনে দিনে বাড়ছে। বর্তমানে চারটি অনুষদের ১৯টি বিভাগে পড়ুয়া মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ হাজার ৫৪৭ জন। জাতীয় কবিকে নিয়ে গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ।
সজীব আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে কিছু দূর এগোতেই চুরুলিয়া মঞ্চের সামনে চোখে পড়ে বেশ বড়সড় জটলা। ঢোলের তালে সেই জটলায় চলছে নৃত্য। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেদিন বিশ্ব নাট্য দিবস। দিবসটি উদ্যাপন করছেন নাট্যকলা ও পরিবেশনা বিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। আসছে পয়লা বৈশাখ। নতুন বাংলা বছরকে স্বাগত জানাতে শুরু হয়ে গেছে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি। এদিকে ১৯ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন। এ উপলক্ষেও চলছে ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ। সব মিলিয়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়েই চোখে পড়ল উৎসবমুখর পরিবেশ।

ক্লাসের ফাঁকে শিক্ষার্থীদের সময় কাটে পাঠাগারে
ক্লাসের ফাঁকে শিক্ষার্থীদের সময় কাটে পাঠাগারে

ক্যাম্পাস ঘুরে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাতীয় কবির নামে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এই সম্পর্ক পাঠদানকে অনেক সহজ করে দেয়। শিক্ষার্থীরা বলেন, অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে তাঁরা এখানে পড়তে এসেছেন। শিক্ষকদের সহযোগিতায় সেই স্বপ্নের পথে ঠিকঠাক এগোচ্ছেন। তাঁদের চলার পথে সাহস জোগাচ্ছে বিদ্রোহী কবি, তারুণ্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা-প্রবন্ধ-কথামালা। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চূড়ান্ত বর্ষের শিক্ষার্থী সাবিকুন নাহার বলেন, ‘আমাদের শুধু বইয়ের ভাষাতেই পড়ানো হয় না। পাঠদান প্রক্রিয়ায় শিক্ষার প্রায়োগিক দিককে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এতে সত্যিকার অর্থেই দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে উঠছে বলে আমি মনে করি।’

প্রাঙ্গণজুড়ে নজরুল
বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৯টি বিভাগের শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হয় ১০০ নম্বরের ‘নজরুল স্টাডিজ’। যাতে থাকে কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও কর্মের মূল্যায়ন। শুধু পাঠ্যসূচিতেই নয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনা থেকে শুরু করে বাসের নামেও মিশে আছে কবি নজরুলের সৃষ্টিকর্মের নাম। একমাত্র ছাত্রী হলের নাম দোলনচাঁপা আর একমাত্র ছাত্র হলের নাম অগ্নিবীণা। প্রধান মঞ্চের নাম ‘গাহি সাম্যের গান’। ক্যাফেটেরিয়ার নাম চক্রবাক আর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নাম ব্যথার দান। সদ্য নির্মিত উপাচার্যের বাসভবনের নাম দেওয়া হয়েছে দুখু মিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসগুলোর নাম বিদ্রোহী, সাম্যবাদী, ঝিঙেফুল আর সাঁঝের তারা।

চলছে পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি
চলছে পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি

সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য। ক্যাম্পাসে রয়েছে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর শাখা। বছরব্যাপী দেশীয় সাংস্কৃতিক আয়োজনে ব্যস্ত থাকে উদীচী। নাট্যালয় নামের একটি সংগঠন নিয়মিত আয়োজন করে নাটক, নৃত্য ও কোরিওগ্রাফি–বিষয়ক কর্মশালা। রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য সংসদ নামের আরও একটি উল্লেখযোগ্য সংগঠন। এই সংগঠন থেকে অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয় পাণ্ডুলিপি ও সুচ নামে দুটি সাহিত্য পত্রিকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিবেট সোসাইটি ও ফটোগ্রাফি সোসাইটি শিক্ষার্থীদের প্রিয় সংগঠন। এ ছাড়া নাট্যকাল ও পরিবেশনা বিদ্যা বিভাগ এবং সংগীত বিভাগ নানা আয়োজনে সারা বছর ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখে। নিয়মিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েও সাফল্য অর্জন করছেন এই দুটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে বেশ কিছু প্রাপ্তি। ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ ও ইউজিসির যৌথ আয়োজনে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় ২৩টি ইভেন্টের মধ্যে ১৩টিতেই স্বর্ণপদক পান নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। প্রতিযোগিতায় দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অংশ নেয়।

সমস্যা-সংকট
২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে কিছু সমস্যা-সংকট। সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র দুটি হল। ধারণক্ষমতা ৪৪০। বাকি শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের গ্রামে গড়ে ওঠা বাড়িতে ভাড়া থাকেন। ওই সব বাড়িতে জীবনযাপনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নেই। পরিবহনসংকট ও শ্রেণিকক্ষের সংকটেও ভুগছেন শিক্ষার্থীরা। তবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এসব সংকটকে খুব বড় করে দেখেন না। ধীরে ধীরে এসব সংকট কেটে যাবে বলে তাঁদের বিশ্বাস। এমন বিশ্বাসের কারণও আছে। জানা গেল, বর্তমানে ক্যাম্পাসে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ চলছে।

মোহীত উল আলম
মোহীত উল আলম

সম্ভাবনা আকাশছোঁয়া
মোহীত উল আলম
উপাচার্য, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা আকাশছোঁয়া। আমাদের দক্ষ শিক্ষকসহ রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তিগত সুবিধা। এসব কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীদের আমরা দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি করছি। আমাদের প্রধান লক্ষ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আদর্শ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। সে লক্ষ্যে শিক্ষকেরা কাজ করছেন।