প্রশাসনের বিরুদ্ধে রাবি শিক্ষকের ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ

দুর্নীতিমুক্ত ‍শিক্ষাঙ্গনের দাবিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ফরিদ খান শহীদ শামসুজ্জোহা চত্বরে খালি পায়ে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানান। ছবি: শহীদুল ইসলাম
দুর্নীতিমুক্ত ‍শিক্ষাঙ্গনের দাবিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ফরিদ খান শহীদ শামসুজ্জোহা চত্বরে খালি পায়ে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানান। ছবি: শহীদুল ইসলাম

‘দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন চাই, শিক্ষকের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চাই’—প্ল্যাকার্ড নিয়ে শহীদ শামসুজ্জোহা চত্বরে মাথা নত করে খালি পায়ে দাঁড়িয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ফরিদ খান। তিনি আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত জোহা চত্বরে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

অন্যদিকে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি ও সম্প্রতি উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহানের ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানকে স্বাধীনতাবিরোধী আখ্যা দিয়ে দুর্নীতিবাজ প্রশাসনের অপসারণের দাবি জানিয়ে আন্দোলন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর একাংশ।

মো. ফরিদ খান ফরিদ বলেন, ‘বিবেকের তাড়নায় আমি দাঁড়িয়েছি। সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনে যে অরাজকতা, অনিয়ম, দুর্নীতি চলছে—এটা আমাদের জাতির জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। বঙ্গবন্ধু কন্যা ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আমি উনার কাছে আহ্বান জানাই, শিক্ষাঙ্গনের দুর্নীতির বিরুদ্ধেও উনি যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কারণ শিক্ষাঙ্গনে এ অবস্থা থাকলে যত উন্নয়নই আমরা করি না কেন, সেগুলো কোনো কাজে আসবে না।’ তিনি বলেন, ‘জোহা স্যারের এখানে দাঁড়ানোর কারণ হলো, জোহা স্যারের আদর্শ আমরা ধারণ করি। দিনের পর দিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান কমে যাচ্ছে। দুর্নীতি হচ্ছে। আমরা যেন আর না পচে যাই। আমরা যেন এখান থেকে উঠে দাঁড়াতে পারি।’

এর আগে গতরাতে নিজের ফেসবুকে অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক লেখেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা সবচেয়ে উঁচুতে রেখে ৭৩-এর অধ্যাদেশে শিক্ষকদের জবাবদিহি রাখেননি। কিন্তু আজকে শিক্ষকেরাই শিক্ষকদের মর্যাদা ধরে রাখতে পারেননি। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অবস্থা দেখলে সত্যিই ব্যথিত হতেন।

এর আগে গত বছরের ৩ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে খালি পায়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন মো. ফরিদ খান।

আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবন সংলগ্ন প্যারিস রোডে ‘স্বাধীনতাবিরোধী ও দুর্নীতিবাজ প্রশাসনের অপসারণ চাই’ ব্যানারে দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষকসমাজের এক সমাবেশে অর্ধশতাধিক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে মানববন্ধন করে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। শিক্ষার্থীরা ‘দুর্নীতির আস্তানা ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও/স্বজনপ্রীতির আস্তানা ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’—স্লোগান দিতে দিতে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষকদের সঙ্গে সমাবেশে যোগ দেন।

‘স্বাধীনতাবিরোধী ও দুর্নীতিবাজ প্রশাসনের অপসারণ চাই’—স্লোগানে মানববন্ধন করে রাবির দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষক সমাজ ও শিক্ষার্থীবৃন্দ। ছবি: শহীদুল ইসলাম
‘স্বাধীনতাবিরোধী ও দুর্নীতিবাজ প্রশাসনের অপসারণ চাই’—স্লোগানে মানববন্ধন করে রাবির দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষক সমাজ ও শিক্ষার্থীবৃন্দ। ছবি: শহীদুল ইসলাম

সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক গ্রন্থাগার প্রশাসক সফিকুন্নবী সামাদী বলেন, ‘আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখতে চাই। আমরা চাই না, আত্মীয় প্রতিপালনের একটি খামারে পরিণত হোক এই বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে সঠিক জ্ঞান চর্চা হোক, যার অন্তরায় এই দুর্নীতবাজ প্রশাসন। এই প্রশাসনের শীর্ষ পর্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত। আমরা এই প্রশাসনের অপসারণ চাই।’

সমাবেশে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘একজন উপাচার্য স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রীয় সত্তার সঙ্গে একধরনের সাংঘর্ষিক বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু উপাচার্য হিসেবে এ রকম বক্তব্য প্রত্যাশা করা যায় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘কয়েক দিন আগে একটি অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়েছে। আমরা মনে করি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নিয়োগ বাণিজ্য হচ্ছে, এটা তারই একটা অংশ হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে। এই প্রশাসন এ রকম দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এখন সারা দেশে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলছে। আমরা শিক্ষকেরা মনে করি, এই আন্দোলনে আমাদেরও অংশগ্রহণ করা উচিত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শীর্ষ পদে বসে যারা এ রকম দুর্নীতি করছে আমরা তাদের সরিয়ে দেওয়ার কথা বলছি। তারা সরে যাক এবং স্বচ্ছ প্রশাসন তৈরি হোক।’

এ সময় ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক আলী রেজা অপু বলেন, দুর্নীতিবাজ প্রশাসনের দুর্নীতির শিকড় এই শিক্ষাঙ্গন থেকে উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত শিক্ষক সমাজ আন্দোলন চালিয়ে যাবে। এই যৌক্তিক দাবির আন্দোলনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।

এদিকে একই দাবিতে শিক্ষকদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরাও। শিক্ষকদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে সমাবেশে অংশ নেন তাঁরা। সমাবেশে অংশ নেওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থীরা।

মানববন্ধনে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ রাবি শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদুল ইসলাম মুবিন বলেন, ‘উপ-উপাচার্যের ফোনালাপ ফাঁস হওয়ায় যে নিয়োগ বাণিজ্য প্রকাশ্যে এসেছে আমরা তার চরম ধিক্কার ও নিন্দা জানাই। তার দাবি এটা এডিট করে প্রচার করা হয়েছে। আমরা চাই তিনি অতি দ্রুত এটা প্রমাণ করে দেখাক। তার নৈতিক স্খলন ঘটেছে। আমরা চাই তিনি সসম্মানে পদত্যাগ করুক।’

রাকসু আন্দোলন মঞ্চের আহ্বায়ক আবদুল মজিদ অন্তর বলেন, ‘উপাচার্যের জয় হিন্দ স্লোগান ও উপ-উপাচার্যের অর্থ নিয়ে অডিও ফাঁসের ঘটনায় ধারাবাহিকভাবে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা চাই উপাচার্য তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে দুঃখ প্রকাশ করবেন এবং উপ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়া পদত্যাগ করবেন।’

গত সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) রাতে আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার আগে চাকরিপ্রার্থী নুরুল হুদার স্ত্রী তুজ সাদিয়ার সঙ্গে উপ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়ার ঘুষ লেনদেন সংক্রান্ত ফোনালাপ ফাঁস হয় । নুরুল হুদা একই বিভাগ থেকে ভালো ফলাফল করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদক ও প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক পান।

এ ঘটনার পরদিন সমালোচনার মুখে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে একটি প্রতিবাদ লিপি পাঠান অধ্যাপক জাকারিয়া। সেখানে তিনি দাবি করেন, ফোনালাপটি এডিট করে প্রকাশ করা হয়েছে। যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ বিষয়ে নুরুল হুদা বা তার স্ত্রী সাদিয়া এখনো কথা বলতে রাজি হননি।

তবে ওই বিবৃতিতে উপ-উপাচার্য দাবি করেন, স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে অসাধু কিছু ব্যক্তির কবলে পড়ে নুরুল হুদার আর্থিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে খোঁজ নিতে তার স্ত্রীকে ফোন করেছিলেন তিনি। গত বছরের ১৩ নভেম্বর তারিখের চাকরি বোর্ডের আগে নীলফামারীর সৈয়দপুর শাখার ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ৪ নভেম্বর তারিখের একটি ব্যাংক জমা স্লিপ (লেনদেনের ডকুমেন্ট) পান।