যোগাযোগের শিক্ষা, একযোগে

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির কমিউনিকেশন অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির কমিউনিকেশন অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

এক দুপুরবেলায়, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির লিসেনিং ল্যাবে উঁকি দিয়ে দেখা গেল, গোল হয়ে বসেছেন প্রায় ৪০ জন শিক্ষার্থী। মাঝখানে দাঁড়িয়ে ইংরেজি বলার নানা খুঁটিনাটি দিক তুলে ধরছিলেন তিনজন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এটি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি কমিউনিকেশন অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবের নিয়মিত আয়োজন ‘ইংলিশ স্পিকিং অ্যাক্টিভিটি’র নিয়মিত অধিবেশনের একটি অংশ।

ইংরেজি বলার জড়তা দূর করতে চাইলে চর্চার কোনো বিকল্প নেই। তাই নিয়মিত চর্চা বজায় রাখার লক্ষ্য নিয়েই ক্লাবটি সপ্তাহে চার দিন এ অধিবেশন পরিচালনা করে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো শিক্ষার্থী চাইলেই এতে অংশ নিতে পারেন। আয়োজনটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে ক্লাবের ইংলিশ স্পিকিং অ্যাক্টিভিটির পরিচালক জান্নাতুল নাইম বলেন, ‘ট্রাইমেস্টারের শুরুতেই সপ্তাহে কোন দিন কোন বিষয় নিয়ে সেশনে আলোচনা করা হবে, তা মেন্টর ও ক্লাবের উপদেষ্টা হিসেবে আমাদের যে শিক্ষকেরা রয়েছেন, তাঁরা সম্মিলিতভাবে ঠিক করেন। আমরা প্রতিটি বিষয় কোনো খেলার মাধ্যমে বা কোনো বাস্তব ঘটনার মাধ্যমে বোঝাতে চেষ্টা করি; কেননা এতে ইংরেজি বলার প্রাথমিক জড়তা দ্রুতই কেটে যায়।’

শুধু ইংরেজি ভাষা চর্চার এই নিয়মিত আয়োজনটিই নয়, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি কমিউনিকেশন অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব কাজ করছে বাংলা, চায়নিজসহ আরও বিভিন্ন ভাষা ও ইফেক্টিভ কমিউনিকেশন বা যথার্থ যোগাযোগপদ্ধতির নানা উপায় নিয়ে। ক্লাবটির সার্বিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে ক্লাবের অ্যাডভাইজার ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ফারিনা হক বলেন, ‘ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ল্যাঙ্গুয়েজেসের ডেপুটি ডিরেক্টর লিজা রেশমিন আপার উদ্যোগে ২০১২ সালে ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্লাবটি প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের ভাষার দক্ষতা বৃদ্ধি করা, সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানো এবং সর্বোপরি আমাদের সব ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সহমর্মিতার চর্চা করা। এ ছাড়া আমরা সবাই মনে করি, কর্মক্ষেত্রে এখন যোগাযোগ দক্ষতার (কমিউনিকেশন স্কিল) গুরুত্ব অপরিসীম, তাই এই দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্লাবটি প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।’

ক্লাবটির উদ্যোগে কখনো আয়োজিত হচ্ছে ইংরেজি উপস্থিত বক্তৃতার প্রতিযোগিতা, কখনো আবার দক্ষ ব্যক্তির উপস্থিতিতে আয়োজিত হচ্ছে যোগাযোগের কর্মশালা। সেই ধারাবাহিকতাতেই জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্লাবটি আয়োজন করেছিল বাংলা ও ইংরেজি ছোটগল্প লেখার প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতাটির পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বরেণ্য কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। দুটি ভাষায় সৃজনশীলতা চর্চার সুযোগ করে দেওয়ার এ প্রয়াসের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘দেশ-কাল-সময়ের বাঁধা পেরিয়ে বিশ্বদরবারে পৌঁছাতে হলে মাতৃভাষা বাংলা ও আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি—দুটিতেই দক্ষ হওয়া ভীষণ প্রয়োজন। আমাদের দেশে অনুবাদ সাহিত্যের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। কারণ, দুটি ভাষাতেই দক্ষ—এমন মানুষ পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ রকম সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তোমাদের এ উদ্যোগ নিশ্চয় মঙ্গলজনক হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই কেবল নিজের পাঠ্যপুস্তকের বিষয় আর ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার ছাড়া কিছু ভাবে না। আবার অনেকে খুব মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও নিজের বক্তব্য উপস্থাপনযোগ্য করে তুলতে পারেন না। তাই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি কমিউনিকেশন অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব সমান গুরুত্ব দিয়েছে ভাষার দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি যোগাযোগের বিষয়টিতেও। এ ছাড়া ক্লাবের সদস্যরা নিয়মিত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা ও বিনোদনের জন্য নানা আয়োজন করেন, তাদের সঙ্গে সময় কাটান।

ক্লাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ক্লাবের সদস্য ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী দেবমিত্র দাস বলেন, ‘বিভিন্ন ভাষা নিয়ে আমাদের ক্লাবের নানা আয়োজন, যোগাযোগের সঠিক দিক, ভুল দিক নিয়ে নিয়মিত আলোচনায় অংশ নেওয়ার মাধ্যমে আমি জানতে পেরেছি, সঠিক শব্দ চয়ন ও সঠিক ভঙ্গিতে তা বলার মধ্যেই রয়েছে বক্তব্যের সার্থকতা।’ দেবমিত্রের মতো অন্য সদস্যরাও জানান, এই সচেতনতাবোধ সৃষ্টিতে ক্লাব একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া একসঙ্গে কাজ করার, সফলভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করার আনন্দের কথাও বললেন কেউ কেউ। ‘কোনো একটি অনুষ্ঠানের আগে থিম ঠিক করা, সেভাবে আয়োজনটি সাজানো, অতিথিদের আমন্ত্রণ করা, অনুষ্ঠান পরিচালনার বিষয়গুলো এই যে আমরা কর্মজীবনে প্রবেশের আগেই হাতে–কলমে শিখছি—এটি অবশ্যই একটি দারুণ ব্যাপার। পড়ালেখার পাশাপাশি যখন ক্লাবের ছোট-বড় সবাই মিলে আমরা এ কাজগুলো করি, নিজেদের একটি বড় পরিবারের সদস্য মনে হয়।’ বলছিলেন ক্লাবের সদস্য ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের শিক্ষার্থী সজীব দে।

ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই চোখ পড়ল ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ল্যাঙ্গুয়েজের বাইরে রাখা হাতে বানানো একটি পোস্টারে। নানা তীর চিহ্ন দিয়ে তাতে লেখা—২২১/বি বেকার স্ট্রিট, ২১ রজনী সেন রোড, ফোর প্রিভেট ড্রাইভ...এমন অনেক ঠিকানা। আদতে এগুলো বিভিন্ন গল্পের চরিত্রের বাড়ির ঠিকানা। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, ফেলুদা, শার্লক হোমস, হ্যারিপটারসহ বিশ্বসাহিত্যের চরিত্রগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া এই পোস্টারটিও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি কমিউনিকেশন অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবের সদস্যদের তৈরি। এভাবেই হয়তো ক্লাবের সদস্যরা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছেন বিভিন্ন ভাষার প্রতি, নিজের ভাষাকে জানার পাশাপাশি হয়ে উঠছেন বিশ্বনাগরিক।