তাহসীনের টাইম মেশিন

তাহসীনুল হক
তাহসীনুল হক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাহসীনুল হকের পড়ার বিষয় ইতিহাস নয়, সমাজবিজ্ঞান। তিনি যে খুব ইতিহাসভক্ত, তা-ও নয়। তবে হ্যাঁ, তাহসীন ছবি তুলতে ভালোবাসেন। তাঁর তোলা ছবিতে ফুটে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত-বর্তমান। সময় পরিভ্রমণযন্ত্র বা টাইম মেশিনের মতো করেই তাহসীনের ছবি আপনাকে নিয়ে যাবে বহু বছরের পুরোনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে।

২০১০ সালের কথা। তাহসীনুল হক যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন, তখন ঘাড়ে চেপেছিল ফটোগ্রাফির ‘ভূত’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ভূতটা জেঁকে বসে আরও। শখের দাম নাকি লাখ টাকা। তাই পেশাদার ক্যামেরা কিনে ঘুরে ঘুরে শখ মেটানো শুরু করেন। ক্যামেরা হাতে ক্যাম্পাসে একটা নিজস্ব পরিচিতি তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি। শুরুতে থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলা শুরু করেন। ছবিগুলো গুগল স্ট্রিট ভিউতে রাখেন। সেসব ছবি এখন পর্যন্ত ১০ লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। গুগলের সেরা ‘থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি’ ছবির তালিকায় তাহসীনুল হকের বেশ কয়েকটি ছবি স্থান পেয়েছে।

১৯৫০ সালে তোলা কার্জন হলের ছবিটির সঙ্গে মিলিয়ে ছবি তুলতে তাহসীনকে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় আড়াই ঘণ্টা! ছবি: তাহসীনুল হক
১৯৫০ সালে তোলা কার্জন হলের ছবিটির সঙ্গে মিলিয়ে ছবি তুলতে তাহসীনকে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় আড়াই ঘণ্টা! ছবি: তাহসীনুল হক

এ সময় ‘ফলো মি টু’র ট্রেন্ড শুরু হলো। তাহসীন আরেকটা সিরিজ বানালেন। ‘ফলো মি টু ডিইউ’ নামে। এসব ছবি ‘বিউটি অব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নামের ফেসবুক গ্রুপে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তাহসীনের ওপর তাঁর ছবির দর্শকদের প্রত্যাশা বাড়তে থাকে।

এর মধ্যে তাহসীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু পুরোনো, ঐতিহাসিক ছবি পেয়ে যান। খুঁজে খুঁজে আরও অনেক পুরোনো ছবি বের করেন। খুঁজতে থাকেন এসব ছবির ইতিহাস। তখনই তাঁর মাথায় ধারণাটা আসে।

অপরাজেয় বাংলা
অপরাজেয় বাংলা

পুরোনো ছবিগুলো প্রিন্ট করেন তাহসীন। তারপর সেই একই জায়গায়, একই ফ্রেমে এ সময়ের একটা ছবি ধারণ করে রাখেন। ধারণাটা বাস্তবায়ন করতে কিন্তু কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি। পুরোনো ছবির সঙ্গে নতুন ছবির সামঞ্জস্য রাখা সহজ নয়। যেমন ধরুন, ১৯৫০ সালের কার্জন হলের একটা ছবি পেয়েছিলেন তাহসীন। সেই ছবিতে একটা গাড়ি দেখা যায়। এই সময়ে দাঁড়িয়ে, একই রকম একটা গাড়ির জন্য তাহসীন অপেক্ষা করেছেন প্রায় আড়াই ঘণ্টা। যখন জায়গামতো গাড়ির দেখা পেয়েছেন, ঝটপট ক্লিক করেছেন।

টিএসসি এখনো আগের মতোই প্রাণচঞ্চল
টিএসসি এখনো আগের মতোই প্রাণচঞ্চল

রোকেয়া হলের পুরোনো ছবিটা ১৯৮১ সালের। তখন হলের সামনে চলছিল পদাতিক নাট্যদলের পথনাটক ক্ষ্যাপা পাগলের প্যাঁচাল। সেই ছবির সঙ্গে বর্তমান রোকেয়া হলকে মেলাতে গেলে একটু বিপাকেই পড়তে হয়। কারণ, হলের সেই গেট আর নেই। আশির দশকের মতো পথনাটকের প্রচলনও আর নেই। বদলে গেছে ভিসি চত্বর।

১৯৬৫ সালে রজার গোয়েনের তোলা ছবিটির সঙ্গে বর্তমান ভিসি চত্বরের মিল বলতে ওই সুবিশাল কড়ইগাছটিই। এখন তো এখানে ১৯৭১ সালের গণহত্যার প্রতীকস্বরূপ গড়ে তোলা হয়েছে ‘স্মৃতি চিরন্তন’। রজার গোয়েনের তোলা টিএসসির মোড়ের ছবিতে খেয়াল করলেই পাওয়া যাবে কালীমন্দির। এখন অবশ্য বদলে গেছে চিত্র। তবে স্বপ্ন নিয়ের সঙ্গে আলাপের সময় তাহসীন বলেন, ‘অনেক কিছু বদলে গেলেও টিএসসির চরিত্র বা সংস্কৃতি বদলায়নি। আগেও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্ধু, আড্ডা, গান আর চা ছিল, এখনো আছে। টিএসসিকে বলা যেতে পারে এক টুকরো বাংলাদেশ।’ ১৯৮০-র দশকে ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্রের ভেতরে তোলা একটি দুর্লভ ছবি আর বর্তমান ছবি পাশাপাশি রাখলে তাহসীনের কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। টিএসসির প্রাণচাঞ্চল্য এতটুকু কমেনি।

জগন্নাথ হল
জগন্নাথ হল

তবে ‘ধ্বংসস্তূপে’ পরিণত হয়েছে টিএসসির সুইমিংপুল। ষাটের দশকের ছবিতে ছাত্ররা ঝাঁপিয়ে পড়ছে সুইমিংপুলের পানিতে। এখনকার পরিত্যক্ত সুইমিংপুলের দিকে তাকিয়ে আগের ছবিটাকে কাল্পনিক মনে হয়। বিখ্যাত আলোকচিত্রী নওয়াজেশ আহমেদের ১৯৭০ সালে তোলা এনেক্স ভবনের একটি ছবি খুঁজে পান তাহসীন। ছবির সেই ভবনটিই বর্তমান মোতাহার হোসেন ভবন। তাঁর ছবিতে ১৯৪০ সালে মানিকগঞ্জের বালিয়াটির তৎকালীন জমিদার কিশোরলাল রায়চৌধুরীর বানানো জগন্নাথ হল দেখা যায়। সেটি এখন কেবল ছবি হয়েই আছে।

ছবির এই সিরিজ তৈরি করতে কেমন লাগল? তাহসীন বললেন অনেক গল্প। সেসবের সারকথা একটাই, মানুষের ভালো লাগছে এসব ছবির ভাবনা আর গল্প। সেসব স্পর্শ করছে তাহসীনকে। বর্তমানেরা মিলিয়ে দেখছেন, কেমন ছিল তাঁদের অতীত। আর অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী, যাঁরা এখন বিদেশে আছেন বা অনেক বয়স হয়ে গেছে, তাঁরা এসব ছবি দেখে নিজেদের ফেলে আসা দিনগুলোতে ফিরে গেছেন। এসব ছবি শেয়ার করে লিখছেন নিজেদের অভিজ্ঞতার গল্প। একবার হলেও ভাবছেন, আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি!