ঢাবির ফার্মাসি বিভাগের চেয়ারম্যান একাই এক শ

ফার্মাসি বিভাগের চেয়ারম্যান সীতেশ চন্দ্র বাছার। ছবি: সংগৃহীত
ফার্মাসি বিভাগের চেয়ারম্যান সীতেশ চন্দ্র বাছার। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগে শিক্ষক মাত্র একজন। ক্লাস–পরীক্ষা চালাতে হয় অন্য বিভাগের শিক্ষক ধার করে। অথচ এক শিক্ষকের এই বিভাগ প্রায় সাড়ে ছয় লাখ চাকরিপ্রার্থীর পরীক্ষা নিতে যাচ্ছিল। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন ও অনিয়মের গুঞ্জনে গত ২৪ সেপ্টেম্বর নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করেছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। আর তাতে বিপাকে পড়ছেন বিপুলসংখ্যক চাকরিপ্রার্থী।

নিয়ম অনুযায়ী বাইরের এ ধরনের নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টি ফার্মাসি অনুষদের একাডেমিক সভায় উত্থাপন করার কথা। কিন্তু ফার্মাসি বিভাগের একমাত্র শিক্ষক ও চেয়ারম্যান সীতেশ চন্দ্র বাছার এককভাবে এই পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্তে আপত্তি জানান ফার্মাসি অনুষদের ডিন এস এম আবদুর রহমান। তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে এ ধরনের পরীক্ষা আয়োজনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে চিঠি দেন। তিনি এটাও জানান, দুর্বল ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম বা দুর্নীতি হলে তার দায়ভার ফার্মাসি অনুষদ নেবে না।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তার অভিযোগ, এই নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে প্রশ্নপত্র ফাঁস, মেধাতালিকায় পছন্দের প্রার্থীদের নাম রাখা ও চাকরি নিশ্চিত করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল একটি চক্র। এর সঙ্গে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। তাঁদের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রশ্নপত্র ছাপা, সারা দেশে কেন্দ্র, শিক্ষক নির্ধারণসহ সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়।

জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিতের পরপর মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দু–এক দিনের মধ্যে প্রতিবেদন হাতে পেলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। এরপর করণীয় নির্ধারণ করা হবে।

পরীক্ষাসংক্রান্ত অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গাজি মোহাম্মদ নুরুল কবির বলেন, ‘ফার্মাসি বিভাগের চেয়ারম্যানের নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়ার সক্ষমতা আছে বলেই তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ফার্মাসি অনুষদের ডিনের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। আমরা ঝুঁকি নিতে চাইনি। তবে আমাদের ধারণা, তাঁদের দুজনের মধ্যে বোঝার ঘাটতির কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।’

সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ৯ জুলাই হাউস প্যারেন্টস কাম টিচার, সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর, ফিল্ড সুপারভাইজার, সমাজকর্মী (ইউনিয়ন), অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মুদ্রাক্ষরিক, গাড়িচালক ও অফিস সহায়ক পদে বিজ্ঞপ্তি দেয় সমাজসেবা অধিদপ্তর। এর মধ্যে সমাজকর্মী বাদে বাকি পদগুলোতে নিয়োগে পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের ডিপার্টমেন্ট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস)।

গত সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে ৪৬৩টি সমাজকর্মী পদে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার জন্য ফার্মাসি বিভাগের চেয়ারম্যান সীতেশ চন্দ্র বাছারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় সমাজসেবা অধিদপ্তর। পরে তিনিই প্রশ্নপত্র তৈরি করেন। গত ২৭ সেপ্টেম্বর এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।

গত ২২ সেপ্টেম্বর সমাজকল্যাণমন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়ে এস এম আবদুর রহমান বলেন, এই পরীক্ষার সঙ্গে তাঁর অনুষদ কোনোভাবেই সম্পৃক্ত না। এর দুই দিন পর ২৪ সেপ্টেম্বর পরীক্ষা স্থগিত করে সমাজসেবা অধিদপ্তর। অথচ এর আগেই ওএমআর শিট তৈরি ও প্রশ্নপত্র ছাপানো হয়েছে। পরে তা ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতেও পাঠানো হয়েছিল। ঢাকা ছাড়া সাতটি বিভাগীয় শহরে এই পরীক্ষা নেওয়ার জন্য ৩ কোটি ৮৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, পরে তা স্থগিত রাখা হয়েছে।

ডিন এস এম আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষা নিতে হলে আগে অনুষদের একাডেমিক সভায় জানাতে হয়। সবার সম্মতি থাকলে একটি পরিচালনা কমিটি করার বিধান রয়েছে। অথচ এই নিয়োগে তার কিছুই করা হয়নি। কে, কবে এবং কীভাবে এই নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার কিছুই তিনি জানতেন না। অথচ এই পরীক্ষায় ৬ লাখ ৬২ হাজার ২৭০ জন চাকরিপ্রার্থী আবেদন করেছিলেন। তাঁদের অনেকেই পরীক্ষার আগে চাকরির জন্য ফার্মাসি অনুষদে যোগাযোগ করেছেন। এর মধ্যে পরীক্ষার পর ওএমআর রিডিংয়ের সময় নম্বর টেম্পারিং করে নির্দিষ্টসংখ্যক পরীক্ষার্থীকে পাস নম্বর দেওয়াসহ নানা রকম দুর্নীতির বিষয়ে খবর ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় বিষয়টি তিনি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন।’

তবে ফার্মাসি অনুষদের চেয়ারম্যান সীতেশ চন্দ্র বাছার বলেন, ‘ফার্মাসি অনুষদের অধীনে আরও তিনটি বিভাগ রয়েছে। এসব বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেই এই পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাঁদের প্রত্যেকের নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে তিনি বিষয়টি একাডেমিক সভায় উপস্থাপন করেননি। মূলত এ কারণে এমন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।’

বিষয়টি নিয়ে গত বৃহস্পতিবার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, যে বিভাগে একজন মাত্র শিক্ষক, যাঁদের সক্ষমতা নেই, সেখানে কেন পরীক্ষা নেওয়ার কাজ দেওয়া হলো—কমিটি এই প্রশ্ন রেখেছে। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।