তারকা নয়, মানুষ গড়া লক্ষ্য

মঞ্চে কুয়েট থিয়েটারের নাটক
মঞ্চে কুয়েট থিয়েটারের নাটক

‘আমাদের ক্যাম্পাসে একটা সুন্দর পুকুর আছে। আমরা ভালোবেসে বলি প্রেম-পুকুর। সেই পুকুরপাড়ে ছয়-সাতজন মিলে প্রথমবারের মতো রিহার্সাল শুরু করেছিল। এভাবে একদিন হঠাৎ কোনো ঘোষণা ছাড়াই একটি নাটকের মধ্য দিয়ে পথচলা শুরু।’ বলছিলেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফারহান আকিফ। সাংস্কৃতিক ধারায় কোনো পরিবর্তন বা সাংস্কৃতিক আন্দোলন থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের যেকোনো সাংস্কৃতিক আয়োজনে মূল ভূমিকায় থাকে সংগঠনটি। কুয়েট থিয়েটারের স্লোগানটাও তাই জুতসই—‘মৃতের মননশীল মুক্তি’। প্রতিবছর নিজস্ব প্রযোজনায় দু-তিনটি নাটক মঞ্চে আনে তারা।

এটি শুধু থিয়েটার বা সাংস্কৃতিক সংগঠন নয়, সামাজিক সংগঠনও বটে। আকিফ বলেন, ‘এ বছর কোরবানির ঈদে আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলাম। সদস্যদের আমরা দুটি ছবি তুলতে বলি—একটা কোরবানির আগে, আরেকটা পরে। এভাবে সামাজিকভাবে অবদান রাখার চেষ্টা করি আমরা। তা ছাড়া সম্প্রতি এডিস মশা নিধন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের রাস্তা সংস্কারের জন্য আমরা মাননীয় উপাচার্যের কাছে একটা স্মারকলিপি দিই। আগামী ডিসেম্বরের আগেই আশা করি রাস্তার কাজ শুরু হবে।’

বর্তমানে কুয়েট থিয়েটারের সদস্য ১২০ জনের বেশি। নিয়মিত সদস্য অন্তত ৬০ জন। সদস্য সংগ্রহের ব্যাপারে আকিফ বলেন, ‘নতুন ব্যাচ ক্যাম্পাসে এলে আমরা বিভাগে গিয়ে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাই। এরপর নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট স্থানে দেখা যায় প্রায় ২০০ জন চলে এসেছে। তবে শেষ পর্যন্ত প্রায় ৩০ জন নিয়মিত থাকে। সবাইকে সদস্যপদ দেওয়া হয়ে ওঠে না। প্রথম তিন-চারটা আয়োজনে যারা সক্রিয় থাকে, শুধু তাদের আমরা সদস্য করে নিই। সেটা অবশ্য এক বছর পরে হয়। এর মধ্যে তাদের আমরা থিয়েটারের ফেসবুক গ্রুপে অ্যাড করি। সেখানে আমাদের সিনিয়র অনেক ভাই আছেন। তাঁদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের একটা সুযোগ তৈরি হয়। শহরতলি ব্যান্ডের ভোকাল জিল্লুর রহমান আমাদের সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।’

কুয়েট থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ১৪ ডিসেম্বর। তাই দিনটি উদ্‌যাপন হয় একটু অন্যভাবে। সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘প্রতিবছর এই দিনে আমরা বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা তুলে ধরে একটা নাটক মঞ্চায়ন করি। সারা বছর অন্যান্য সময় মৌলিক নাটক করা না গেলেও অন্তত এই সময়টায় মৌলিক নাটক করার একটা চেষ্টা থাকে।’

তবে একটি নাটক পরিপূর্ণভাবে মঞ্চায় করা চাট্টিখানি কথা নয়। এ জন্য পরিশ্রম করতে হয় বেশ। সভাপতি মো. রুবায়েত ইসলাম খান জানালেন, সদস্যদের জন্য নিজেদের চরিত্রটা আত্মস্থ করা জরুরি। তিনি বলেন, ‘একটা নাটক আমরা সর্বোচ্চ সাত দিনের মধ্যে তুলে ফেলি। ছোট নাটিকার ক্ষেত্রে দুই দিনের মতো সময় লাগে। নতুনদের অভিজ্ঞতা কম থাকায় সময় একটু বেশি প্রয়োজন হয়। তবে যে নিজের চরিত্রকে আত্মস্থ করে, তার সংলাপগুলো সেভাবে উপস্থাপন করতে পারে, তার জন্য কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়।’

তবে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে সেই সময়টুকু বের করাও তো কঠিন। সে কাজটাই বা তাঁরা করছেন কীভাবে? জবাবে আকিফ বললেন, ‘আমরা আসলে প্রকৌশলে কীভাবে কম সময়ে বেশি উৎপাদন করা যায়, তা শিখি। আমরাও সেভাবে দ্রুত নিজের কাজগুলো সেরে ফেলার চেষ্টা করি। সেখানে যে সময়টা বাঁচে, তা থেকে কেউ থিয়েটার করে, কেউ গান গায়। এভাবে সময় বের করতে হয় আমাদের। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াটা চমৎকার বলে খুব একটা সমস্যা হয় না।’

বোঝাপড়া থাকার আরেকটা সুবিধার কথা বললেন রুবায়েত, ‘আমাদের সদস্যদের মধ্যে সাংগঠনিক সম্পর্কের চেয়ে বরং একরকম পারিবারিক সম্পর্কই তৈরি হয়ে গেছে। আর এই বোঝাপড়ার কারণে সভাগুলোতে সবাই মিলে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ হয়ে যায়।’

মূলত বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংগঠন হওয়ার পরও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে কুয়েট থিয়েটার। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কুয়েট থিয়েটারের অংশগ্রহণ বেশ ধারাবাহিক। আকিফ বলেন, ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর তিন দিনব্যাপী একটা নাট্যোৎসব হয়। আমরা কয়েক বছর ধরে সেখানে অংশগ্রহণ করছি। তা ছাড়া খুলনার অন্য অনুষ্ঠানগুলোতেও নিয়মিত অংশগ্রহণ করি।’ আক্ষেপের সঙ্গে তিনি যোগ করলেন, ‘খুলনায় নাটকের অবস্থানটা কবিতা বা গানের মতো এতটা গোছানো না। সমন্বয়ের অভাবে দেখা যায়, অনেক সময় কোনো কোনো নাট্য আয়োজনের ব্যাপারে আমরা জানতেই পারি না।’

কথায় কথায় থিয়েটারের বিশেষ একটা লক্ষ্যের কথা জানালেন সাধারণ সম্পাদক। ‘আমরা প্রায় সব সভাতেই একটা কথা বলি, কুয়েট থিয়েটার গতানুগতিক তারকা তৈরি করে না, মানুষ তৈরি করে। তাই আমাদের প্রস্তুতিটাও হয় এমনভাবে, যেন সবাই নিজের প্রতিভা বিকাশের পাশাপাশি একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।’

কথা হলো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়েও। আকিফ জানালেন, ‘আগামী ফেব্রুয়ারিতে একটা নাট্যোৎসব করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। দেশের অন্তত সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে সেখানে আমন্ত্রণ করতে চাই।’ আর, রুবায়েত বললেন অংশগ্রহণ বাড়ানোর কথা। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমাদের এখনো খুব বেশি পরিচিতি তৈরি হয়নি। সামনে আরও অংশগ্রহণ বাড়াতে চাই। আর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সব সংগঠন মিলে একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে চাই।’