অপ্রতিরোধ্য অদ্বিতীয়া

বাঁ থেকে শাওন্তী ইসলাম, তমা বর্মা, সুমাইয়া তাসনিম, সাবরিনা মনছুর, শান্তা যাদব, লক্ষ্মী মনি কুর্মী, দোলেনা খাতুন, আজিমা খাতুন, সোহানা আক্তার ও মার্জিয়া ইসলাম। ছবি: সৌরভ দাশ
বাঁ থেকে শাওন্তী ইসলাম, তমা বর্মা, সুমাইয়া তাসনিম, সাবরিনা মনছুর, শান্তা যাদব, লক্ষ্মী মনি কুর্মী, দোলেনা খাতুন, আজিমা খাতুন, সোহানা আক্তার ও মার্জিয়া ইসলাম। ছবি: সৌরভ দাশ
পরিবারের প্রথম নারী, যিনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পৌঁছেছেন, এ রকম ১০ জন অদম্য শিক্ষার্থীকে অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল প্রথম আলো ট্রাস্ট। এই কার্যক্রমের আওতায় ২০১২ সালে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) সঙ্গে প্রথম আলোর একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৭ সাল থেকে এই প্রকল্পে যুক্ত হয় আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড। প্রকল্পটির নাম েদওয়া হয় ‘অদ্বিতীয়া’। এ বছর এর আওতায় যোগ হচ্ছেন আরও ১০ জন। নানান বাধা ডিঙিয়ে তাঁদের স্থান হয়েছে আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়—এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে। ১০ শিক্ষার্থীর গল্প শুনেছেন তাসনীম হাসান

নিজের জেলাকে পরিচিত করতে চাই : শাওন্তী ইসলাম

কৃষক বাবার যা আয়, তা দিয়ে কোনোমতে চলে পরিবার। বাবার পক্ষে মেয়ে শাওন্তী ইসলামের পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব ছিল না। তাই মেয়ের পড়া চালিয়ে নিতে একপর্যায়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করেন মা ফারজানা ইয়াসমিন। মা-মেয়ের সেই যৌথ প্রচেষ্টা অবশেষে পেয়েছে সাফল্য। এইউডব্লিউতে ভর্তি হয়েছেন শাওন্তী। মিলেছে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদ্বিতীয়া বৃত্তিও। এখন আর তাঁকে আটকায় কে? কিন্তু এত কিছুর পরও শাওন্তীর একটি দুঃখ আছে। এইউডব্লিউয়ের বন্ধুরা যখন জিজ্ঞেস করেন, ‘বাড়ি কোথায়?’ শাওন্তী বলেন, ‘জয়পুরহাট।’ বন্ধুরা তখন পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘সেটা কোথায়?’ শাওন্তীর ইচ্ছে, পড়ালেখা করে, আশপাশের শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে নিজের এলাকাকে এমনভাবে গড়ে তুলবেন, যেন জয়পুরহাটকে সবাই এক নামে চেনে।

আবেদন ফরম পর্যন্ত কিনতে পারিনি : লক্ষ্মী মনি কুর্মী

২০১৭ সাল। সবে এইচএসসি পাস করা লক্ষ্মী মনি কুর্মী স্বপ্ন দেখছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন। কিন্তু ভর্তির আবেদন ফরম কেনার মতো সামর্থ্য তো ছিল না। ঘরে বসে কান্নাকাটি করে দিন কাটছিল তাঁর। মেয়ের কান্না দেখে স্থানীয় একটি ডিগ্রি কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন বাবা রতন কুর্মী। সেখানে পড়তে পড়তে স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকের মাধ্যমে লক্ষ্মী মনি জানতে পারেন এইউডব্লিউ সম্পর্কে। অবশেষে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়ে স্বপ্ন পূরণ হয় তাঁর, এখন দৃষ্টি আরও দূরে।

লক্ষ্মী মনি জনস্বাস্থ্য নিয়ে পড়তে চান। কারণ, তাঁর গ্রামের মানুষ স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন নয়। আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদ্বিতীয়া বৃত্তি কীভাবে তাঁর স্বপ্নের পথে আরও এগিয়ে নেবে, বলছিলেন তিনি, ‘মা-বাবা অনেক কষ্ট করে আমার জন্য টাকা পাঠান। সেই টাকা খরচ করতে খুব খারাপ লাগে। এখন বৃত্তি পাওয়ায় মা-বাবাকে সহযোগিতা করতে পারব।’

দুশ্চিন্তা দূর করেছে বৃত্তি : আজিমা খাতুন

‘কৃষকের মেয়ের আবার স্কুল!’ অনেকেই টিপ্পনী কাটত আজিমা খাতুনকে লক্ষ্য করে। কিন্তু তাঁর বাবা সব সময় বলতেন—গোবরে যদি পদ্ম ফুল ফোটে, কৃষকের মেয়ে কেন উচ্চশিক্ষিত হতে পারবে না? সেই প্রেরণায় এসএসসি-এইচএসসি দুটোতেই আজিমা পান জিপিএ-৫। টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতেন। তাই এইউডব্লিউতে সুযোগ পাওয়ার পরও দুশ্চিন্তায় ছিলেন এই ভেবে—‘গ্রামে তো টিউশনি করেছি। এখানে টিউশনি কোথায় পাব?’ তাঁর সেই দুশ্চিন্তা দূর করেছে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদ্বিতীয়া বৃত্তি। ইচ্ছা ছিল চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়বেন, সেটি পূরণ না হওয়ায় এখন পড়তে চান জনস্বাস্থ্য বিষয়ে। গ্রামের মানুষের জন্য নিশ্চিত করতে চান চিকিৎসাসেবা।

নৈশ বিদ্যালয় খুলতে চাই : সোহানা আক্তার

বেশি দূর পড়া হয়নি সাইদুর রহমান ও ডলি বেগমের। তাই দুজন স্বপ্ন দেখতে থাকেন একমাত্র মেয়ে সোহানা আক্তারকে নিয়ে। ভাবতেন মেয়ে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। কিন্তু তাই বলে একেবারে এইউডব্লিউতে ভর্তির সুযোগ পাবে—এতটা মা-বাবার কল্পনাতেও ছিল না। মা–বাবার স্বপ্ন পূরণ করার পর সোহানা এখন ভাবছেন আশপাশের মানুষের জন্য। জানালেন, পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান। এরপর গ্রামের মানুষকে করতে চান আলোকিত। গ্রামের অনেক মানুষ দিনভর কাজ করেন। তাই তাঁদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে নৈশ বিদ্যালয় খুলতে চান তিনি।

ছোট ভাইদের পড়ালেখায় সহযোগিতা করতে পারব : শান্তা যাদব

মৌলভীবাজারের চা–বাগান থেকে একেবারে এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে—শান্তা যাদব যেন এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও শান্তা যাদবের দুশ্চিন্তা কমছিল না এতটুকু। ভাবছিলেন কোথায় পাবেন হাতখরচ, কোথায় পাবেন বাড়িতে আসা–যাওয়ার গাড়ি ভাড়া। এমন সময় তিনি পেলেন আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদ্বিতীয়া বৃত্তি। তাই শান্তা বলেন, ‘এখন প্রতি মাসে বাড়িতে যেতে পারব। নিজের খরচ তো মেটাতে পারবই, ছোট ভাইদের পড়ালেখায়ও সহযোগিতা করব।’ চা–বাগানেই তাঁর বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছেন নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। এসব তাঁকে খুব পোড়ায়। তাই শান্তা ভবিষ্যতে তাদের জন্য কিছু করতে চান।

 শিক্ষক হতে চাই : সুমাইয়া তাসনিম

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাবা আর গৃহিণী মা স্বপ্ন দেখতেন মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করবেন। কিন্তু অভাবের কারণে সেই স্বপ্ন বারবার ধাক্কা খাচ্ছিল। এমন সময় গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে জানতে পারেন এইউডব্লিউতে ভর্তির বিষয়টি। লিখিত আর মৌখিক পরীক্ষায়ও উতরে যান সুমাইয়া। তিনি বলেন, ‘আমি যেই স্কুল ও কলেজে পড়েছি, সেখানকার শিক্ষকেরা আমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখছেন। আমি তাঁদের সেই স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। পড়াশোনা শেষে যোগ দিতে চাই শিক্ষকতা পেশায়।’

 অষ্টম শ্রেণি থেকে টিউশনি করি : তমা বর্মা

তমা বর্মার বাবা জয়ন্ত বর্মা চা–শ্রমিক। দিনভর গায়ে-গতরে খেটে পান ১০২ টাকা। এই অল্প টাকায় পরিবারের পাঁচজনের খাবার জোগাড় করা যেখানে অসম্ভব, সেখানে আবার পড়াশোনা? তবু মেয়ে তমা বর্মার অদম্য ইচ্ছে দেখে বাধা হয়ে দাঁড়াননি মা–বাবা। নিজেও চেষ্টা চালিয়ে গেছেন তমা। পড়াশোনার খরচ চালাতে অষ্টম শ্রেণি থেকে টিউশনি শুরু করেন তিনি। মৌলভীবাজারের কামুদপুরে চা–বাগানে বেড়ে ওঠা তমা বর্মা এখন এইউডব্লিউতে ভর্তি হয়েছেন। বলছিলেন, ‘আমার এলাকার কেউ ভাবেনি আমি এত দূর আসতে পারব। সারা জীবন অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি।’ তমার স্বপ্ন খুব সুন্দর—চা–বাগানে একটা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল করতে চান তিনি।

কেউ যেন বাল্যবিবাহের শিকার না হয় : সাবরিনা মনছুর

কৃষক বাবা মনছুর আলীর পক্ষে মেয়ের পড়াশোনার দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব হয়নি। দুঃসময়ে সাবরিনা মনছুরের পাশে এসে দাঁড়ান চাচাতো বোন, স্কুলশিক্ষক রোকসানা বেগম। স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত তাঁর সহায়তায় পড়াশোনা করেন সাবরিনা। সম্প্রতি তাঁর ছোট ভাইয়ের পড়ালেখার দায়িত্বও নিয়েছেন এই চাচাতো বোন। তাই সাবরিনা মনে মনে ভাবছিলেন, কোনোভাবে যদি পরিবারকে সাহায্য করা যেত! আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদ্বিতীয়া বৃত্তি সেই সুযোগ করে দিল।

সাবরিনা বলেন, ‘দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় এইউডব্লিউর কথা জানতে পারি। তখন থেকে স্বপ্ন দেখেছিলাম, এখানে পড়ব।’ সাবরিনা এখন নিজের এলাকার মেয়েদের তাঁর মতো করে গড়ে তুলতে চান। আর নিশ্চিত করতে চান, কারও যেন অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে না যায়।

সমাজকর্মী হতে চাই : দোলেনা খাতুন

‘মেয়েদের এত পড়াশোনা করিয়ে কী হবে? বিয়ে দিয়ে দাও’—কৃষক দিলদার মিয়াকে বহুবার শুনতে হয়েছে এ কথা। কিন্তু সেসবকে একেবারে পাত্তা দেননি তিনি। ‘লোকের কথা’র আঁচড় থেকে আগলে রেখেছেন মেয়েকেও। কাঁধে বাবার হাত ছিল বলেই মেয়ে সাহস পেয়েছেন, দোলেনা খাতুন এখন এইউডব্লিউয়ের ছাত্রী। দোলেনা পড়তে চান জনস্বাস্থ্য বিষয়ে। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এ রকম একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তাই স্বপ্নটা হয়েছে আরও বড়। দোলেনা এখন সমাজকর্মী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করতে চান তিনি।

আম্মুর ওপর ভার কমেছে : মার্জিয়া ইসলাম

আসবাবের ব্যবসায় সর্বস্বান্ত হয়ে বাবা মো. তুহিন ইসলাম যখন দিশেহারা, মার্জিয়া ইসলাম তখন সবে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তেন। একদিকে সংসার, অন্যদিকে মেয়ের পড়াশোনা। একেবারেই অসহায় হয়ে পড়ে পরিবারটি। তাই বাধ্য হয়ে মা মুকুল জাহান বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করেন। মাস শেষে যা আয় হতো, তা দিয়ে সংসারের খরচ মেটানোর পাশাপাশি মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে নিয়েছেন। সেই মার্জিয়ার উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ করেছে এইউডব্লিউ। সঙ্গে বৃত্তির টাকা পাওয়ায় মার্জিয়া খুব খুশি। হেসে বললেন, ‘এই বৃত্তি আম্মুর ওপর চাপ কমিয়ে দিয়েছে। এতেই আমার আনন্দ।’

ডেভ ডোল্যান্ড
ডেভ ডোল্যান্ড
১৯টি দেশের শিক্ষার্থী আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে
ডেভ ডোল্যান্ড
রেজিস্ট্রার, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন
নানা প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও যেই নারীদের মধ্যে নেতৃত্ব বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এইউডব্লিউ তাঁদের জন্য একটি স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সমাজের গঠন ও সৃজনশীল চিন্তার মধ্যে যে সীমানা আছে, আমরা সেটা ভেঙে ফেলতে চাই। এশিয়া থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত, ১৯টি দেশের শিক্ষার্থী আছে আমাদের এখানে। দেশ, জাতি, সংস্কৃতির সম্মিলন যে মানুষকে পেশাজীবনে এগিয়ে রাখে, আমাদের স্নাতকদের সফলতা তারই প্রতিফলন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন অনেকে আছে, যারা তাদের পরিবারের মধ্যে প্রথম উচ্চশিক্ষা নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আমরা চাই, কলা ও বিজ্ঞান বিষয়ে গভীর ও বড় পরিসরের শিক্ষা পেয়ে তাদের তুরীয় চিন্তা (ক্রিটিক্যাল থিংকিং) করার দক্ষতার পাশাপাশি সমাজকে কিছু দেওয়ার সক্ষমতা ও কাজের অভিজ্ঞতা গড়ে উঠুক। বিশ্বজুড়ে আমাদের নেটওয়ার্কের সহায়তায় শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক শিক্ষানবিশি (ইন্টার্নশিপ) ও চাকরির সুযোগ পায়। যেসব শিক্ষার্থী সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল, যারা অন্যের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চায়, তাদের আমরা আমাদের সঙ্গে চাই।