বুয়েটের অচলাবস্থা আগামী সপ্তাহে কাটতে পারে

বুয়েটে প্রশাসনিক কার্যক্রম সচল হলেও শিক্ষা কার্যক্রম অচল রয়েছে। ভবন আর চিরচেনা গাছগুলো আগের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেও প্রতিষ্ঠানটিতে নেই প্রাণচাঞ্চল্য। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক অসহযোগে কার্যত অচল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি তোলা হয়েছে, যদিও এই দাবিতে শিক্ষকদের দৃশ্যমান কর্মসূচি নেই।

বুয়েটে এই অচলাবস্থার কারণ—শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড। এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র এবং বুয়েটের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দোষী হিসেবে যাঁদের নাম উঠে আসবে, তাঁদের বুয়েট থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করলেই একাডেমিক অসহযোগের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। মামলার অভিযোগপত্র এবং বুয়েট প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন—দুটিই আগামী সপ্তাহে প্রকাশের সম্ভাবনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। ফলে আগামী সপ্তাহে বুয়েটের অচলাবস্থা কাটতে পারে।

৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন শাখা ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। এরপর আবরার হত্যার বিচারসহ বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১১ অক্টোবর বুয়েট ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন বুয়েটের উপাচার্য সাইফুল ইসলাম। ভর্তি পরীক্ষা উপলক্ষে শর্ত সাপেক্ষে ১৪ অক্টোবর আন্দোলন শিথিল করা হয়। পরে সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসে ১৬ অক্টোবর গণশপথের মধ্য দিয়ে মাঠের আন্দোলনে ইতি টানেন শিক্ষার্থীরা। তবে মামলার অভিযোগপত্র এলে সে অনুযায়ী অভিযুক্তদের বহিষ্কার না করা পর্যন্ত একাডেমিক অসহযোগের ঘোষণা দেন তাঁরা।

আবরার হত্যার ঘটনায় ৭ অক্টোবর তাঁর বাবা বরকত উল্লাহ ১৯ জনকে আসামি করে রাজধানীর চকবাজার থানায় মামলা করেন। সেই মামলায় এখন পর্যন্ত এজাহারভুক্তসহ মোট ২১ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্ত শেষে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে (আগামী সপ্তাহে) আবরার হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে বলে ১৩ অক্টোবর সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম।

আবরার হত্যার ঘটনায় বুয়েট প্রশাসনের করা তদন্ত কমিটিও আগামী সপ্তাহে প্রতিবেদন দেবে বলে গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে জানিয়েছেন বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান।

এদিকে গতকাল বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেছেন, মামলার অভিযোগপত্র এবং বুয়েটের করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের বুয়েট থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হলেই কেবল তাঁরা একাডেমিক অসহযোগ প্রত্যাহার করবেন। ১০ দফা দাবির মাত্র দুটি এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়েছে জানিয়ে তাঁরা সব দাবির পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবি করেন। পিছিয়ে পড়ছেন জেনেও বৃহত্তর স্বার্থে একাডেমিক অসহযোগ করছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান শিক্ষার্থীরা।

তবে ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের পরিচালক দাবি করেন, শিক্ষার্থীদের যেসব দাবি পূরণের এখতিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের রয়েছে, সেগুলো ইতিমধ্যে পূরণ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও তাঁদের নিয়মিত কথা হচ্ছে।

রিমান্ড ও স্বীকারোক্তি

আবরার হত্যা মামলায় ৮ অক্টোবর ১০ জনকে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠান। তাঁরা হলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান, সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান (রবিন), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার, গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ, ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম, সমাজসেবাবিষয়ক উপসম্পাদক ইফতি মোশাররফ, সদস্য মুনতাসির আল জেমি, মুজাহিদুর রহমান ও খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম।

প্রথম দফায় এই ১০ জনের পাঁচজন রিমান্ডে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন, ৫ জনকে পাঠানো হয় কারাগারে। তবে দ্বিতীয় দফা রিমান্ডে নেওয়া হলে ২১ অক্টোবর তাবাখখারুল ইসলাম স্বীকারোক্তি দেন।

 ৯ অক্টোবর আরও তিনজনের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। তাঁরা হলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান, কর্মী শামসুল আরেফিন ওরফে রাফাত ও আকাশ হোসেন। ১৫ অক্টোবর মনিরুজ্জামান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সেদিন রাফাতকে দ্বিতীয় দফায় চার দিনের রিমান্ডে ও আকাশকে কারাগারে পাঠানো হয়। দ্বিতীয় দফা রিমান্ড শেষে ২০ অক্টোবর রাফাতকেও কারাগারে পাঠানো হয়।

১১ অক্টোবর তৃতীয় দফায় আরও দুজনকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠান আদালত। তাঁরা হলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা ও কর্মী হোসাইন মোহাম্মদ তোহা। রিমান্ড শেষে ১৭ অক্টোবর তোহাকে কারাগারে পাঠান আদালত। আর অমিতকে দ্বিতীয় দফায় তিন দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়। ২০ অক্টোবর অমিতকেও কারাগারে পাঠান আদালত।

১২ অক্টোবর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কর্মী মাজেদুর রহমান, শামীম বিল্লাহ ও মোয়াজ আবু হুরায়রার পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ১৬ অক্টোবর শাখা ছাত্রলীগের আরেক কর্মী নাজমুস সাদাতের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। রিমান্ড শেষে ১৮ অক্টোবর মাজেদ এবং ১৯ অক্টোবর শামীম ও মোয়াজকে কারাগারে পাঠানো হয়।

২২ অক্টোবর স্বীকারোক্তি দিলে নাজমুস সাদাতকে কারাগারে পাঠানো হয়। ২৩ অক্টোবর শাখা ছাত্রলীগের কর্মী মিজানুর রহমানের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড শেষে গতকাল তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

সর্বশেষ ২৮ অক্টোবর বুয়েটের সাবেক ছাত্র এস এম মাহমুদের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। এর আগে গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে মাহমুদের নাম আসে এবং তিনি ওই হলে থাকতেন।