শিক্ষায় সংখ্যায় যথেষ্ট উন্নতি, মানে বেশ পিছিয়ে

১০ বছর আগে প্রাথমিকে ভর্তির হার ছিল ৯৪ শতাংশের সামান্য বেশি। এখন সেই হার প্রায় ৯৮ শতাংশ। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শুরুর বছর ২০০৯ সালে পাসের হার ছিল প্রায় ৮৯ শতাংশ, এখন তা ৯৮। প্রাথমিকে এসব ইতিবাচক চিত্র এসেছে সরকার, দাতা ও বেসরকারি সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।

এই অগ্রগতির বিপরীতে এটাও সত্য যে প্রাথমিকে অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী বাংলা ও গণিতে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। প্রায় ১৯ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই ঝরে পড়ছে।

বিপরীতমুখী এই চিত্রগুলো স্পষ্টতই ইঙ্গিত দিচ্ছে, প্রাথমিক শিক্ষায় সংখ্যায় যথেষ্ট উন্নতি হলেও মানে পিছিয়ে রয়েছে। কেবল প্রাথমিকে নয়, মাধ্যমিক, কলেজ ও উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত কমবেশি এই বিপরীতমুখী চিত্র বিরাজ করছে।

শিক্ষাক্ষেত্রে বড় অভিযোগ, শ্রেণিকক্ষে পড়াশোনা কমে গেছে। সব ক্ষেত্রেই কোচিং-প্রাইভেট বা নোট-গাইড বইয়ের দাপট। মুখস্থ বিদ্যা পরিহার করে শিক্ষার্থীরা বুঝে শিখবে ও লিখবে—এমন স্বপ্ন থেকে এক দশক আগে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। বাস্তবে এখনো ৪০ শতাংশের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ঠিকমতো এই পদ্ধতিতে প্রশ্নই করতে পারেন না। শিক্ষকেরাই যেখানে এই পদ্ধতি ঠিকমতো রপ্ত করতে পারেননি, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীদের বেশি সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে প্রায় ৩৫ কোটি বই দিচ্ছে, কিন্তু শিক্ষাক্রম ও বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশ্ন আছে।

আবার শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। উপাচার্যদের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে এখনো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা চলছে। নিয়োগ–বদলি ঘিরে প্রশ্ন আছে।

 তবে পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রবণতা বন্ধ হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের চেষ্টায় বিষয়টি এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আছে।

যেসব উপজেলায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ নেই, সেগুলোতে একটি করে বিদ্যালয় ও কলেজ সরকারি করা হয়েছে। দীর্ঘ ৯ বছর পর সম্প্রতি ২ হাজার ৭৩০টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত (বেতন-ভাতার সরকারি অংশ প্রদান) করা হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের অধীনে পরীক্ষা নিয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। এ ছাড়া অনলাইনে ভর্তিপ্রক্রিয়া চালু, পরীক্ষার পরিবর্তে লটারির মাধ্যমে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করার বিষয়গুলো ইতিবাচকভাবে দেখছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

তবে ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর এই দীর্ঘ সময়েও প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করাসহ শিক্ষানীতির গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষানীতি অনুযায়ী, সব শিক্ষকের জন্য পৃথক বেতনকাঠামো, স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন এবং শিক্ষক নিয়োগে পিএসসির আদলে কমিশন গঠনও হয়নি। এমনকি শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য যেটি বেশি দরকার, সেই শিক্ষা আইনও আটকে আছে। শিক্ষার বাজেটও দীর্ঘদিন ধরেই একই বৃত্তে ঘুরছে।

 শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. সোহরাব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে সংখ্যায় যে উন্নতি হয়েছে, সেটাকে ধরে রেখে গুণগত শিক্ষার প্রসার ঘটানোই তাঁদের মূল চ্যালেঞ্জ। এ জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কর্মমুখী তথা কারিগরি শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে কারিগরিতে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে কাজ চলছে।

প্রাথমিকে মানসম্মত শিক্ষায় ঘাটতি

ব্যানবেইসের তথ্য বলছে, ২০১০ সালে দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল ৮২ হাজার ৬৭৪টি। এগুলোর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ৩৭ হাজার ৬৭২টি। ৯ বছর পর এখন প্রাথমিক স্তরের মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৪৭টি। এগুলোর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫ হাজার ৬২৬টি। প্রাথমিকে এখন মোট শিক্ষার্থী পৌনে ২ কোটি। ১০ বছর আগে প্রাথমিক বিদ্যালয় গমনোপযোগী দেড় কোটির মতো শিক্ষার্থী ভর্তি হতো। প্রাথমিকে ছাত্রীদের ভর্তির হার প্রায় ৫১ শতাংশ।

তবে প্রাথমিকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থী বাড়লেও এই স্তরে নানা সমস্যা বিরাজ করছে। শিক্ষাবিদেরা বলছেন, প্রাথমিকের পড়াশোনা এখন পরীক্ষানির্ভর। যদিও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে, ২০২১ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রথাগত পরীক্ষা থাকবে না। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হবে শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিকভাবে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার কারণে এখন সমস্যা বাড়ছে। বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণায় দেখা যায়, এই সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য দেশের ৮৬ দশমিক ৩ শতাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে হয়।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, শুধু প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা দিয়ে অর্জন যাচাই করা যাচ্ছে না। কারণ, সরকারের উদ্যোগে করা মূল্যায়নেই দেখা যায়, অধিকাংশ শিশু ঠিকমতো ভাষা ও অঙ্ক শিখতে পাচ্ছে না। এখানে মানসম্পন্ন শিক্ষা হচ্ছে না।

বেশি সমস্যা মাধ্যমিকে

ব্যানবেইসের তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৫ সালে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল ১২ হাজার ১২টি, আর এখন মোট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২০ হাজার ৪৬৫টি। অর্থাৎ ২৪ বছরে বিদ্যালয় বেড়েছে ৮ হাজার ৪৫৩টি। এই সময়ে ছাত্রীদের ভর্তির হার বেড়ে ছাত্রদের চেয়ে বেশি হয়েছে। ২৪ বছর আগে মাধ্যমিকে ছাত্রীদের ভর্তির হার ছিল প্রায় ৪৭ শতাংশ। এখন ছাত্রীদের ভর্তির হার প্রায় ৫৪ শতাংশ।

প্রাথমিকের মতো এখানেও কাঙ্ক্ষিত শিখন হচ্ছে না। ২০১৪ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, অষ্টম শ্রেণির অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে নির্ধারিত দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না।

 আবার মাধ্যমিকে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালুর এক দশক পার হলেও শিক্ষকেরাই বিষয়টি ঠিকমতো রপ্ত করতে পারেননি। সম্প্রতি গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণা প্রতিবেদনও বলছে, মাধ্যমিকের প্রায় ৪৩ শতাংশ শিক্ষক নিজেরা প্রশ্নপত্র তৈরি করেন। বাকিরা প্রশ্নপত্র কিনে বা অন্যের সহায়তায় পরীক্ষা নেন। প্রতিবেদন বলছে, ৩৭ শতাংশ শিক্ষক গাইড বই ব্যবহার করছেন। মাধ্যমিকে সামগ্রিকভাবে ২২ শতাংশ শিক্ষক গৃহশিক্ষকতা করার কথা জানিয়েছেন। এসব তথ্য বলছে, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ঠিকমতো হচ্ছে না।

>
  • প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সবখানেই শিক্ষার্থী বৃদ্ধিসহ সংখ্যাগত বিভিন্ন সূচকে উন্নতি হয়েছে
  • কিন্তু মান নিয়ে প্রশ্ন কমছে না

মাউশির একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মাধ্যমিক শিক্ষায় দুটি বড় সমস্যার একটি হলো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা কমিটির অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকসংকট। শিক্ষকের সংকট যেমন আছে, তেমনি মানসম্পন্ন শিক্ষকের ঘাটতিও বেশি। মাউশির তথ্য বলছে, নতুন জাতীয়করণ হওয়া বিদ্যালয় মিলিয়ে এখন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৬৬২টি।

কমবেশি একই চিত্র উচ্চমাধ্যমিক স্তরে (কলেজ)। সেখানেও শ্রেণিকক্ষের চেয়ে কোচিং-প্রাইভেটের দাপট বেশি।

উচ্চশিক্ষায় নানা সংকট

২০০৯ সালে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৩১টি, তখন সেগুলোতে গড়ে ছাত্রীদের হার ছিল ৩১ শতাংশ। আর এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৪৯টি, এগুলোতে ছাত্রীদের গড় হার ৩৭ শতাংশ। ২০০৯ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৫১টি, তখন ছাত্রীদের ভর্তির হার ছিল ২৪ শতাংশ। আর এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৫টি এবং ছাত্রীদের হার ২৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থী বাড়লেও এখন নানা সমস্যায় ভুগছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। ইউজিসির তথ্য বলছে, প্রায় ২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই। কোষাধ্যক্ষ নেই প্রায় অর্ধেক বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে সংকট আছে। আবার উপাচার্যদের বিরুদ্ধে নিয়োগ, উন্নয়নকাজের কমিশন নেওয়াসহ স্পর্শকাতর নানা অভিযোগ উঠছে। এখনো অন্তত পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলত উপাচার্যদের কারণেই অস্থিরতা চলছে।

উচ্চশিক্ষা দুর্বল হওয়ায় এবং কাজের সুযোগ কম থাকায় শিক্ষিত বেকার ক্রমাগত বাড়ছে। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। বেকারদের মধ্যে ৩৯ শতাংশই শিক্ষিত বেকার। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কর্মমুখী ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়ার কথা বলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী।

শিক্ষাবিদেরা এখন বলছেন, মান নিয়ে গত কয়েক বছর কথা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু জোরটা সেভাবে দেওয়া হচ্ছে না।

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সংখ্যাগত উন্নয়ন বেশ চমৎকারভাবে হয়েছে, কিন্তু মানের উন্নয়ন সেভাবে হয়নি। বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরে মানের উন্নতি সবচেয়ে কম হয়েছে। আর উচ্চশিক্ষায় মানের দুর্বলতা থেকেই যাচ্ছে। তাঁর মতে, মানবসম্পদের যে গুণ ও মান থাকা দরকার, সেখানে ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এ কারণেই বিশাল অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।