মেয়েদের ক্রিকেট উৎসব

প্রিয় দলকে উৎসাহ দিতে মাঠে হাজির ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী। ছবি: সংগৃহীত
প্রিয় দলকে উৎসাহ দিতে মাঠে হাজির ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী। ছবি: সংগৃহীত

কুমিল্লা সেনানিবাসে প্রায় ১৯ একর জায়গা নিয়ে বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (বাইউস্ট) ক্যাম্পাস। বিশাল একটা খেলার মাঠ আছে এখানে, আর সেই সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছে বাইউস্ট স্পোর্টস ক্লাব। ক্লাবের আয়োজনে আবহাওয়া উপযোগী নানা খেলা বছরজুড়েই চলতে থাকে। কিন্তু সম্প্রতি খেলার মাঠে চোখে পড়ল ভিন্ন এক আমেজ। গত ১ নভেম্বর থেকে দুই সপ্তাহ ধরে আয়োজিত হলো মেয়েদের আন্তবিভাগীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টে। লিগভিত্তিক এই টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি বিভাগের ছাত্রীরা। পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থেকে ফাইনালে মুখোমুখি হয় ইংরেজি ও কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগ। 

১৩ নভেম্বর। দুপুর থেকে নানা আয়োজনে রঙিন হতে শুরু করে খেলার মাঠ। ম্যাচ মাঠে গড়ায় ঠিক বেলা তিনটায়। চারপাশ ঘিরে দাঁড়ান কয়েক শ দর্শক। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষকেরাও যোগ দেন সেই আয়োজনে। ওভারের ফাঁকে ফাঁকে বেজে উঠছিল গান। একদিকে ধারাবিবরণী, অন্যদিকে চার-ছয়-আউটের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের চিৎকারে কেঁপে উঠছিল পুরো মাঠ। 

প্রথমে ব্যাট করে শেষ ওভারে অলআউট হওয়ার আগে ইংরেজি বিভাগ স্কোর বোর্ডে জমা করে ৯৪ রান। তাতে একটা জমজমাট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দ্বিতীয় ইনিংসেরই আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। ফাইনালে না উঠতে পারা দলগুলো ততক্ষণে মাঠ ঘিরে দাঁড়িয়েছে। মাঠের খেলায় নেই তো কী হয়েছে, জার্সি পরেই তাঁরা হাজির হয়েছিলেন পছন্দের দলকে সমর্থন দিতে। 

দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম ৫ ওভার নিজেদের পুরোদমে ম্যাচে টিকিয়ে রাখেন কম্পিউটার বিজ্ঞানের মেয়েরা। ২ উইকেট হারিয়ে করে ফেলেন ৫৪ রান। কিন্তু ষষ্ঠ ওভারে বদলে যায় ম্যাচের রং। দুর্দান্ত একটা ক্যাচ নিয়ে পুরো টুর্নামেন্টে দারুণ ফর্মে থাকা তানিয়া শীলাকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেন ইসরাত জাহান। এই উইকেটের পেছনে বোলার মাহাদিয়া সুমাইয়ার অবদানও কিন্তু কম নয়। 

ব্যস, এর পরই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসে কম্পিউটার বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের হাতে। তাঁদের নিয়ন্ত্রিত বোলিং আর আক্রমণাত্মক ফিল্ডিংয়ের কারণে আর দাঁড়াতেই পারেননি কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের খেলোয়াড়েরা। ১০ ওভার শেষে, ২০ রানে পিছিয়ে থেকে ম্যাচ হারেন তাঁরা। শেষ বলের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি বিভাগের সমর্থকেরা দৌড়ে চলে যান একদম মাঠের মাঝখানে, তারপর সে কী উল্লাস! খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার সুবাদে ম্যাচসেরার পুরস্কার পান মাহাদিয়া সুমাইয়া। 

সব কটি ম্যাচেই মাঠে এসে খেলা দেখে উত্সাহ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও রেজিস্ট্রার। পুরস্কার তুলে দেওয়ার সময় উপাচার্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অধ্যাপক কে এম সালজার হোসেন এনডিসি পিএসসি (অব.) বলেন, ‘এটিই বছরের সেরা আয়োজন।’ মেয়েদের পারফরম্যান্স ও উৎসাহ দেখে তিনি ঘোষণা দেন, এই আয়োজন এখন থেকে নিয়মিত হবে। তবে পুরো টুর্নামেন্টের উদ্যোক্তা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কর্নেল সুমন কুমার বড়ুয়া পিএসসি (অব.)। তিনি বলেন, ‘ক্রিকেট আমাদের দেশে একটা তুমুল জনপ্রিয় খেলা। আমাদের জাতীয় দলের নারী ক্রিকেটাররাও খুব ভালো খেলছেন। কিন্তু ক্রিকেটে মেয়েদের অংশগ্রহণ যতটা হওয়ার কথা ছিল, তার চেয়ে এখনো অনেক কম। কেবল ইনডোর খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে মাঠের খেলায়ও মেয়েদের সমানভাবে সমান অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কারণ, শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পাশাপাশি খেলাধুলা মানুষকে টিমওয়ার্ক শেখায়।’ 

গোটা টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ রান আর উইকেট নিয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্রী তানিয়া শীলা পান টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার। তিনি বললেন, ‘এর আগে কখনোই ক্রিকেট খেলিনি। কিন্তু টিভিতে নিয়মিত খেলা দেখি। নিয়মকানুনগুলো তো জানাই ছিল। এবার টুর্নামেন্টে নাম লেখানোর পর কোচের সহায়তায় দুই সপ্তাহ প্র্যাকটিস করেছি। ব্যস, এটুকুই। এত দিন খেলা দেখার আনন্দটুকু জানতাম। এখন খেলার আনন্দ আর মাঠের আবেগটাও বুঝতে পারছি।’ 

ফাইনালে ২ উইকেট আর ২২ রান করে ম্যাচসেরার পুরস্কার পাওয়া মাহাদিয়া বললেন, ‘ছোটবেলায় ভাইবোনদের সঙ্গে একটু-আধটু খেলেছি। কিন্তু এভাবে প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট আর এত দর্শকের সামনে খেলার অভিজ্ঞতা একেবারেই আলাদা। এই আয়োজন আমাদের সহপাঠীদের বার্তা দেবে, মেয়েরা কেবল সেলফিই তোলে না, ছক্কাও হাঁকাতে পারে!’ চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক নাসরিন তামান্না যোগ করলেন, ‘অনেক মেয়ের মধ্যেই জড়তা কাজ করে, যা তাদের অনেক যোগ্যতা আড়াল করে দেয়। এই আয়োজন জড়তা ভাঙার একটা বিরাট মঞ্চ।’ 

এখানে কেউ পেশাদার খেলোয়াড় নন, কিন্তু পেশাদারি মনোভাব ও আচরণের চর্চা তাঁদের হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনেও প্রেরণা জোগাবে।