ঢাবিতে অবিলম্বে সান্ধ্য কোর্স বন্ধ চায় ডাকসু ও সব ছাত্রসংগঠন

সান্ধ্য কোর্সের ব্যাপারে ইউজিসির নির্দেশনাকে স্বাগত জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদসহ (ডাকসু) ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল সব ধারার ছাত্রসংগঠনের নেতারা। তাঁদের সবার দাবি, অবিলম্বে বাণিজ্যিক সান্ধ্য কোর্স বন্ধ করা হোক। তবে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণমূলক কোর্স রাখার পক্ষে মত দিয়েছে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল।

গতকাল বুধবার দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলমান বাণিজ্যিক সান্ধ্য কোর্স বন্ধ করাসহ ১৩ দফা নির্দেশনা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলছেন, গত মে মাসে সান্ধ্য কোর্সগুলোর বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছিল। এই কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই কোর্সগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সান্ধ্য কোর্সগুলো পর্যালোচনার জন্য গঠিত ওই কমিটির প্রধান করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন তোফায়েল আহমদ চৌধুরীকে। আজ বৃহস্পতিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কাজ এখনো খুব বেশি দূর এগোয়নি। তবে এক মাসের মধ্যে তাঁরা প্রতিবেদন দাখিল করতে পারবেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সান্ধ্য কোর্সগুলোর বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। দুটি সভাও হয়েছে। তবে ভর্তি পরীক্ষাসহ নানা ব্যস্ততার কারণে অনেকেই সভায় ছিলেন না। সান্ধ্য কোর্সের বিষয়ে আমরা এখনো সুপারিশ করার মতো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাইনি। তবে আশা করছি, এক মাসের মধ্যে আমরা প্রতিবেদনটি উপাচার্যের কাছে দাখিল করতে পারব।’

এদিকে বাণিজ্যিক সান্ধ্য কোর্স বাতিলে ডাকসু ও নিজের সংগঠন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের দৃঢ় অবস্থানের কথা জানিয়েছেন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক। আজ সন্ধ্যায় নুরুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনের সময় সব প্যানেলের ইশতেহারেই সান্ধ্য কোর্স বন্ধের দাবিটি ছিল। ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর ডাকসুর একাধিক সভায় আমি বিষয়টি উত্থাপনও করেছি। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে তো দুই ধরনের নিয়ম চলতে পারে না। ডাকসুর ভিপি হিসেবে এবং আমাদের সংগঠন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান সান্ধ্য কোর্সসহ বাণিজ্যিক সব কোর্স বাতিলের দাবি জানাই।’

ডাকসু ভিপি ও কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক অভিযোগ করে বলেন, ‘আসলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেদের স্বার্থেই সান্ধ্য কোর্সগুলো পরিচালনা করে থাকে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি এসব কোর্সের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। আমরা অস্বস্তিতে পড়ি ও অবাক হই, রাষ্ট্রপতির বক্তব্য, সব ছাত্রসংগঠনের বিরোধিতার পরও সান্ধ্য কোর্স বন্ধে প্রশাসনের বক্তব্য ও পদক্ষেপ স্পষ্ট নয়। আসলে শিক্ষকদের বিভিন্ন গ্রুপ ও অর্থনৈতিক ব্যাপার জড়িত থাকায় প্রশাসন এসব কোর্স নিয়ে এত দিন উভয়সংকটে ছিল। কিন্তু এখন আর উভয়সংকটে থাকার সুযোগ নেই। অবিলম্বে বাণিজ্যিক সান্ধ্য কোর্স বাতিল করতে হবে। শিক্ষা কোনো পণ্য নয়।’

বাণিজ্যিক সান্ধ্য কোর্স বাতিলের দাবিতে প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার কথা জানালেন ডাকসুর সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) ও ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। আজ বিকেলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি, বাণিজ্যিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচালনা করা যাবে না। কারণ এটি বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ডাকসুর সভায় সান্ধ্য কোর্স বন্ধের ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইউজিসির নির্দেশনাটির প্রতীকী গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের আশঙ্কা, স্বশাসনের অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্দেশনাটি এড়িয়ে যায় কি না। দ্রুততার সঙ্গে সান্ধ্য কোর্সগুলো বন্ধ করার জন্য আমরা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাই। তবে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণমূলক বিভিন্ন কোর্স রাখার প্রয়োজন রয়েছে।’ তিনি জানান, ডাকসুর দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সান্ধ্য কোর্সের বিষয়ে ওই পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছিল।

সান্ধ্য কোর্সের বিষয়ে একই অবস্থানে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন, তার ওপর আবার বাণিজ্যিক সান্ধ্য কোর্স। এসব কোর্সের কারণে শিক্ষকেরা নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সময় দিচ্ছেন কম। আয় বেশি হওয়ায় সান্ধ্য কোর্সে তাঁদের মনোযোগও বেশি। ছাত্রদল আগেও সান্ধ্য কোর্সের বিরোধী ছিল, এখনো তা-ই। শিক্ষা কোনো পণ্য নয়। আমরা ঢালাওভাবে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সীমিত পরিসরে প্রশিক্ষণমূলক বিভিন্ন কোর্স রাখা যেতে পারে। যেমন, বাংলা বিভাগের কোনো শিক্ষার্থী কম্পিউটারে দক্ষ হতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণমূলক কোর্স করার সুযোগ রাখা যেতে পারে।’

বাণিজ্যিক সান্ধ্য কোর্স বাতিলের পাশাপাশি ইউজিসির ২০ বছরমেয়াদি কৌশলপত্র বাতিলের পক্ষে ছাত্র ইউনিয়ন। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি মেহেদী হাসান আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ইউজিসির ২০ বছরমেয়াদি কৌশলপত্র বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাণিজ্যিক সান্ধ্য কোর্স চালু হয়েছিল। কৌশলপত্রটিতে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালনার রূপরেখা রয়েছে, যা বেসরকারিকরণ বা বাণিজ্যিকীকরণেরই নামান্তর। ফলে, ওই কৌশলপত্র থাকলে সান্ধ্য কোর্স বন্ধ করলেও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বন্ধ হবে না। তাই কৌশলপত্রটি বাতিল করতে হবে। আর শুধু সান্ধ্য কোর্স নয়, বরং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে খোলা সব ধরনের কোর্স বাতিল করা উচিত।

গতকাল দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের পাঠানো এক পরামর্শপত্রে ইউজিসি বলেছে, সান্ধ্য কোর্স পরিচালনা করা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে বিধায় এসব কোর্স বন্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গণহারে চালু হওয়া সান্ধ্য কোর্সের কড়া সমালোচনা করেন। এর দুই দিনের মাথায় ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এমন পরামর্শ দেয়।